হাঁপানি

হাঁপানি হলে কি করবেন? হাঁপানির লক্ষণ ও প্রতীকার সম্পর্কে জেনে নিন

হাঁপানি একটি শ্বাসকষ্টজনিত বক্ষব্যাধি। অনেক সমস্যার কারণে এই হাঁপানি হয়ে থাকে। কয়েক বছর আগে হাঁপানির কারণ সম্বন্ধে চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের যে ধারণা ছিল আজ কিন্তু সেই ধারণার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। অর্থাৎ অনেক বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এবং তথ্যসমৃদ্ধ হয়ে আজকাল বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ হাঁপানির চিকিৎসা শুরু করেছেন। বিশ্বজুড়েই হাঁপানি রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের চেয়ে হাঁপানি নিয়ন্ত্রণ অনেক সময় বেশি কঠিন। কারণ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ভিত্তি হলো খাদ্য নিয়ন্ত্রণ বা রোগীর নিজের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। অথচ হাঁপানি নিয়ন্ত্রণের ভিত্তি ঠাণ্ডা, ধুলা, ভাইরাস বা পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ যার বেশিরভাগের ওপর রোগীর কোনো হাত নেই

হাঁপানি একটি শ্বাসকষ্ট সম্বলিত রোগ। কার্যতঃ এটি শ্বাসনালীর অসুখ। এর ইংরেজি নাম অ্যাজমা যা এসেছে গ্রিক শব্দ Asthma থেকে। বাংলায় হাঁপানি। যার অর্থ হাঁপান বা হাঁ-করে শ্বাস নেয়া। হাঁপানি বলতে আমরা বুঝি শ্বাসপথে বায়ু চলাচলে বাধা সৃষ্টির জন্য শ্বাসকষ্ট (Dyspnoea)।

সারা বিশ্বের প্রায় ১৫ কোটিরও বেশী মানুষ আ্যাজমা বা হাঁপানীতে আক্রান্ত হন। বাংলাদেশে প্রতি বছর ৫০ হাজার লোক এই রোগে আক্রান্ত হয় এবং মাত্র পাঁচ শাতংশ রোগী চিকিৎসা লাভ করে।

হাঁপানি কেন হয়

হাঁপানি যেকোনো বয়সেই হতে পারে। তবে এটি সংক্রামক বা ছোঁয়াচে নয়। প্রদাহজনিত কারণে শ্বাসনালির সংবেদনশীলতা বেড়ে যায়। ফলে ঘন ঘন কাশি, শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা, আওয়াজ, বুকে চাপ বা দম নিতে কষ্ট হওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। যদি সঠিকভাবে উপযুক্ত চিকিৎসা না নেওয়া হয়, তাহলে এ রোগে অনেক সময় মৃত্যুও হতে পারে।

হাঁপানির সঠিক কারণ এখনো জানা যায়নি। এ রোগের জন্য কোনো কিছুকে এককভাবে দায়ী করা যায় না। গবেষণায় দেখা গেছে, কারও কারও বংশগত কারণে বা পরিবেশগত কারণেও এ রোগ হতে পারে। কারও নিকটাত্মীয় যদি এতে আক্রান্ত থাকে বা কেউ যদি বিভিন্ন দ্রব্যের প্রতি অতিমাত্রায় অ্যালার্জিক হয়, তাহলে তার হাঁপানি হতে পারে। শ্বাসনালি যদি অতিমাত্রায় সংবেদনশীল হয়, তাহলে এ রোগ হতে পারে।

এ ছাড়া ধুলোবালির মধ্যে থাকা মাইট নামের ক্ষুদ্র কীট, ফুলের পরাগরেণু থেকে পশুপাখির পালক, ছত্রাক, মল্ট, ইস্ট, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে  গারেটের ধোঁয়ার মধ্যে যারা থাকে তাদের এ রোগ হতে পারে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধূমপান শুধু শ্বাসকষ্টের কারণই নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রেই এটা হাঁপানির তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়।

হাঁপানির ওষুধের কার্যকরতা কমিয়ে দেয়, কখনো ফুসফুসের দীর্ঘস্থায়ী কার্যক্ষমতাও কমে যায়। কখনো কখনো ব্যক্তির পেশাগত কারণেও এ রোগটি হতে পারে। কিছু উত্তেজক উপাদান অনেক সময় সংবেদনশীল রোগীর শ্বাসকষ্ট শুরু করতে পারে যেমনঃ শ্বাসনালির সংক্রমণ, অ্যালার্জি জাতীয় বস্তুর সংস্পর্শ, বায়ুদূষণ, সিগারেটের ধোঁয়ার কারণেও এটি হতে পারে।

কোনো কোনো ওষুধ, যেমন বিটা ব্লকার, যা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহূত হয়, এনএসএআইডি (ব্যথা নিরাময়কারী ওষুধ) এসপিরিন কোনো কোনো ক্ষেত্রে হাঁপানির কারণ হতে পারে।

এ ছাড়া মানসিক চাপে থাকলে হাঁপানির তীব্রতা বেড়ে যেতে পারে। কোনো কোনো খাবারের প্রতি সংবেদনশীল বা চিংড়ি মাছ, হাঁসের ডিম, গরুর মাংস, বেগুন, পুঁইশাক, মিষ্টিকুমড়া, ইলিশ মাছ প্রভৃতি খেলে চুলকায়, নাক দিয়ে পানি পড়ে কারও কারও অর্থাৎ অ্যালার্জি হয়।

তবে খাবারের মাধ্যমে যে অ্যালার্জি হয় তাতে খুব কম লোকের অ্যালার্জি বা শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। বিভিন্ন সুগন্ধি, মশার কয়েল বা কীটনাশকের গন্ধ থেকেও শ্বাসকষ্ট বেড়ে যেতে পারে।

 হাঁপানির লক্ষণসমূহ:

  • শ্বাসকষ্ট
  • সাঁ-সাঁ শব্দে কষ্টসহকারে শ্বাস নেয়া।
  • শুকনো কাশি।
  • বুকে চাপ ধরা বা দম বন্ধভাব অনুভব করা।

এ ছাড়া সব হাঁপানি রোগীকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি নজর রাখতে হবে:

  • ১। ধূমপান এবং তামাকের ধোঁয়ার সংস্পর্শ পরিহার করতে হবে।
  • ২। ঠান্ডা বাতাস হাঁপানির তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়। এ সময় ওষুধের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে হবে।
  • ৩। ব্যায়াম ও শারীরিক পরিশ্রম নিরুৎসাহিত করা উচিত নয়। ব্যায়াম শরীর ভালো রাখে এবং উচ্চরক্তচাপ ও অন্যান্য জটিল রোগবালাই থেকে শরীরকে রক্ষা করে। সঠিক ওষুধ ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যায়ামের সময় বা পরে হাঁপানিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা পরিহার করা সম্ভব।
  • ৪। বাড়ির পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে এবং বাড়িতে অবাধ বিশুদ্ধ বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

চিকিৎসা

হাঁপানি সম্পূর্ণ ভালো করার জন্য এখনো কোনো ওষুধ বের হয়নি। তবে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এ রোগ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। হাঁপানি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগী পুরো সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত হাঁপানি হার্ট অ্যাটাকের মতোই ভয়াবহ।

এতে মৃত্যুও হতে পারে। হাঁপানি নিয়ন্ত্রণের একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো সতর্কভাবে খেয়াল রাখা, কোন কোন উপসর্গে রোগীর শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায় তা নির্ণয় করা এবং তা থেকে দূরে থাকা। কারণ সব হাঁপানি রোগীর রোগের উপসর্গ কমা বা বাড়ার জন্য একই উত্তেজক দায়ী নয়।

অনেক সময় পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপরও আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। হাঁপানির ওষুধ সঠিকভাবে ব্যবহার করলে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবন যাপন সম্ভব।

ওষুধ: দুই ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয়, যেমন:

১। হাঁপানি প্রতিরোধক
২। হাঁপানি উপশমকারক

দুই ধরনের ওষুধ হাঁপানি প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে:

১। এন্টি ইনফ্লামেটরি ওষুধসমূহ: এসব ওষুধ শ্বাসনালির প্রদাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে হাঁপানি প্রতিরোধ করে। এই শ্রেণীর বহুল ব্যবহূত বুসোনাইড, ক্লোমিথাসেন, ফ্লুটিকাসোন ইত্যাদি।
২। ব্রঙ্কোডাইলেটর বা শ্বাসনালি প্রসারক: এসব ওষুধ দ্রুত শ্বাসনালিকে প্রসারিত করে হাঁপানির তীব্রতা প্রতিরোধ করে।

হাঁপানিতে আক্রান্ত হওয়ার সময় শ্বাসনালিতে নিম্নোক্ত পরিবর্তনগুলো দেখা যায়:

১। শ্বাসনালি লাল ও ফুলে যাওয়ার ফলে সরু হয়।
২। শ্বাসনালির চারপাশের মাংসপেশিসমূহ সংকুচিত হয়ে শ্বাসনালিকে আরও সরু করে দেয়।
৩। শ্বাসনালিতে অধিক পরিমাণ শ্লেষ্মা তৈরি হয়ে শ্বাসনালিতে বায়ুপ্রবাহ আংশিকভাবে বন্ধ করে দেয়।

নিম্নে হাঁপানি রোগীদের জন্য কিছু সতর্কতামূলক পরামর্শ দেয়া হলো:

১.যাদের হাঁপানি, অ্যালার্জি আছে, তারা ঠাণ্ডা উপভোগ করতে যাবেন না। ঠাণ্ডায় বের হলে পরিষ্কার স্কার্ফ বা টুপি ব্যবহার করুন। বাইরে বের হওয়ার আগে আপনার নীল রঙের ইনহেলার দুই চাপ ব্যবহার করে নিতে পারেন। বেশি সময় বাইরে থাকতে হলে ইনহেলারটা সঙ্গেই রাখুন।

 ২.শিশুরা অনেক সময় মুখ দিয়ে শ্বাস নেয়। মুখ দিয়ে নেওয়া শ্বাস শুষ্ক এবং শ্বাসতন্ত্র আরও সংকুচিত করে তোলে। অন্যদিকে নাক দিয়ে নেওয়া শ্বাস উষ্ণ এবং আর্দ্র, ধোঁয়া-ধুলা ইত্যাদি ফিল্টার হয়ে আসে। তাই মুখে শ্বাস নেবেন না। শিশুদের বন্ধ নাক সব সময় স্যালাইন ড্রপ দিয়ে পরিষ্কার করে দিন।

 ৩.ধূমপান নিষেধ। এমনকি পাশের ব্যক্তির ধূমপানও আপনার সমস্যা বাড়িয়ে তুলতে পারে। ঠাণ্ডা খাবার ও পানীয় এড়িয়ে চলুন।

 ৪.এমনকি রান্নার ধোঁয়াও শ্বাসকষ্ট বাড়িয়ে দিতে পারে। বাড়িতে কিচেনভেন্ট ব্যবহার করা ভালো। ঘর ধোঁয়ামুক্ত রাখার চেষ্টা করুন। মশার কয়েলও জ্বালাবেন না।

৫.ব্যায়ামের আগে ১০ মিনিট ওয়ার্ম-আপ করে নিন এবং প্রয়োজনে নীল রঙের ইনহেলার দুই চাপ নিয়ে শুরু করুন। অতিরিক্ত শীতে বাইরে না গিয়ে ঘরের ভেতর ব্যায়াম সেরে নিন।

 ৬.সর্দি হলে নাক মুছতে রুমাল নয়, পেপার টিস্যু ব্যবহার করুন। নাক, চোখমুখে ঘন ঘন হাত লাগাবেন না। সর্দি ঝাড়ার পর নিয়মিত সাবান দিয়ে হাত ধোবেন। সর্দি-কাশি-ফ্লু-আক্রান্তদের থেকে দূরে থাকা ভালো।

 ৭.হাঁপানি রোগীরা শীতের শুরুতে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রতি বছর ফ্লু-ভ্যাকসিন নিতে পারেন।

৮.বাড়িতে কুকুর, বিড়াল বা পোষা পাখি শোয়ার ঘর থেকে দূরে রাখুন। ঘরের আসবাব শুষ্ক রাখুন, ধুলা জমতে দেবেন না। আপনার ইনহেলার, ওষুধ, নেবুলাইজার ইত্যাদি রসদ পর্যাপ্ত ও কার্যকর আছে কি না খেয়াল করুন। পরিবারের সবাইকে এগুলোর স্থান ও ব্যবহারপদ্ধতি অবহিত করুন। বাড়িতে প্রাথমিক চিকিৎসার পরও শ্বাসকষ্ট তীব্র হলে অবশ্যই হাসপাতালে চলে যাবেন।

Back to top button