খাদ্য ও পুষ্টিস্বাস্থ্য টিপস

জেনে নিন প্রোটিন শরীরের জন্য কত উপকারি

খাদ্যের একটি অন্যতম উপাদান হলো প্রোটিন। শারীরিক কার্যকলাপে প্রোটিনের প্রয়োজন অবশ্যই আছে, কিন্তু যতটা আমরা গ্রহণ করি তার চেয়ে অনেক কম। আসলে শরীরের দরকার প্রোটিনের মূল উপাদান অ্যামাইনো অ্যাসিড।

পরিপাকের সময় প্রোটিন ভেঙে এই অ্যামাইনো অ্যাসিড তৈরি হয়। মোট ২২টি অ্যামাইনো অ্যাসিডের মধ্যে ১৪টি শরীর নিজেই তৈরি করতে পারে। বাকি ৮টি জরুরি প্রোটিন খাবার থেকে শরীর সংগ্রহ করে।

প্রোটিন দরকার দেহের পুষ্টির জন্য, বৃদ্ধির জন্য। কিন্তু কোন ধরনের প্রোটিন? শস্যদানা, ডাল, শাক-সবজি, ফল প্রভৃতি উদ্ভিজ্জ প্রোটিন না কি মাছ, মাংস, ডিম, দুধ প্রভৃতির প্রাণিজ প্রোটিন?

যে ধরনের প্রোটিনই হোক না কেন ওই মাছ, মাংস, ডিম, দুধের দিকেই সকলের সার্বজনীন প্রবণতা, দুর্বলতা। খাওয়ার সময় এগুলোর একটাও যদি না থাকে তাহলে অনেকেরই মনে হয়, যেন খাওয়া হলো না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রাণিজ প্রোটিন নিয়ে মানুষের বদ্ধমূল ধারণা যে ভ্রান্ত তাই নয়, ক্ষতিকারকও। মানুষ রসনাবিলাসী হলেও দেহ কোনো ধারণা বা রসনার বশবর্তী নয়। প্রাণিজই হোক আর উদ্ভিজ্জই হোক ঠিক যতটুকু প্রোটিন কর্মশক্তির জন্য তার দরকার, ততটুকুই সে ব্যবহার করে। বাকিটুকু ফেলে রাখে ফ্যাট বা মেদ হিসেবে।

কিন্তু এতে দেহে তৈরি টক্সিন বা অধিবিষ, যেমন ইউরিক অ্যাসিড, অ্যামোনিয়া ইত্যাদি। শরীরকে এই টক্সিন যেমন করেই হোক বর্জন করার চেষ্টা করতে হয়। মাছ, মাংস, ডিম, দুধে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন।

তাই অতিরিক্ত পরিমাণে এসব খাবার খেলে দেহে টক্সিন তৈরি হয় এত বেশি মাত্রায় যে শরীর তখন আর বাড়তি টক্সিন বের করে দিতে পারে না। টক্সিন রক্তস্রোতে থেকে যায়। আর এ থেকেই সৃষ্টি হয় বাত, আর্থাইট্রিস, কিডনি ও লিভারের নানা রোগ।

প্রাণিজ প্রোটিনের আরেকটি অন্যতম বিপদ হলো কোলেস্টেরল। এর মাত্রা সীমা অতিক্রম করলে হতে পারে হৃদরোগ, গলব্লাডার স্টোন, চোখের সমস্যা, শ্রবণ সমস্যা ইত্যাদি। অতিরিক্ত প্রাণিজ প্রোটিন খেলে ইনসুলিনের মাত্রা উচ্চ হয়ে গিয়ে হাইপার-ইনসুলিমেনিয়া এমনকি হাইপোগ্লাইসেমিয়া রোগ সৃষ্টি হতে পারে।

এবং উপসর্গ হিসেবে দেখা দিতে পারে রোগীর স্নায়বিক ও মানসিক সমস্যার লক্ষণ। যেমন কোমা, মানসিক বিভ্রান্তি। গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন যে শরীরিক নড়াচড়ার যদি কম করা হয় এবং সেই সঙ্গে বেশ কয়েক বছর উচ্চ মাত্রায় প্রাণিজ প্রোটিন গ্রহণ করা হয়, তাহলে দেখা দিতে পারে অস্টিওপোরোসিস, যে রোগে হাড়গুলো দুর্বল ও ছিদ্রবহুল হয়ে যায়।

যুক্তরাজ্যে এক পরীক্ষায় দেখা গেছে যে ৭০ বছর বয়স্ক নিরামিষাশীদের হাড়, ৫০ বছর বয়স্ক আমিষভোজীদের মতো তো বটেই, বরং তাদের চেয়ে অনেক বেশি মজবুত।

এক্সিমোরা প্রায় পুরোপুরি প্রাণিজ প্রোটিন খেয়ে জীবনধারণ করে। তবু তারা ডিজেনারেটিভ রোগের থেকে রক্ষা পায়। কারণ চিনি, ময়দা প্রভৃতি বিকৃত কার্বোহাইড্রেট তারা খায় না, লবণ ব্যবহার করে না এবং সারাদিন নানা কাজে পরিশ্রম করে প্রচুর। কিন্তু তা সত্ত্বেও ৫০ বছর বয়সেই তারা বুড়ো হতে শুরু করে, ৬০-এর পরে অথর্ব হয়ে পড়ে।

খুব কম সংখ্যক এক্সিমোই ৬০-এর বেশি বাঁচে। আর বাঁচলে ৬০ বছরে রীতিমতো বুড়ো হয়ে যায়। তাছাড়া ওদের মধ্যে রক্তক্ষরণের প্রবণতা খুব বেশি। ছোট থেকে বড় – সকলেরই নাক দিয়ে রক্ত পড়ে। কখনো কখনো এই রক্ত পড়া তিন দিন ধরে চলে এবং রোগী মৃতপ্রায় হয়ে যায়।

অনেকে বলেন প্রাণিজ প্রোটিন উদ্ভিজ্জ প্রোটিনের চেয়ে অনেক বেশি উত্‍কৃষ্ট। এটিও সঠিক কথা নয়। প্রকৃতির দেওয়া সব খাদ্যেই মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড আছে। তাই প্রাণিজ প্রোটিনকে শ্রেষ্ঠ আর উদ্ভিজ্জ প্রোটিনকে নিকৃষ্ট মনে করার কোনো কারণ নেই। বহু গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রাপ্তবয়স্করাও কেবলমাত্র গমজাত খাবার (রুটি, সুজি ইত্যাদি) খেয়েই শরীরে প্রোটিনের প্রয়োজন মেটাতে পারে।

বৈজ্ঞানিকরা বলেছেন, যেসব নিরামিষাশীরা দুধ পর্যন্ত খান না, তাঁরাও প্রয়োজনীয় প্রোটিন পান চাল, গম প্রভৃতি খাদ্যশস্য, ডাল, সবজি ও ফল থেকে। এসব নিরামিষ খাদ্যের প্রত্যেকটিতেই সব রকম অ্যামাইনো অ্যাসিড নেই, কিন্তু এরা মিলেমিশে শরীরকে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি অত্যাবশ্যক অ্যামাইনো অ্যাসিড যোগান দিতে পারে।

এতকিছুর পরও যদি আপনার মনে হয় যে প্রাণিজ প্রোটিন কম খেলে আপনার শক্তি-সামর্থ্য কমে যাবে, তাহলে একবার মেক্সিকোর টারাহুমারা ইন্ডিয়ানদের কথা ভাবুন। ওরা ওদের প্রয়োজনীয় মোট ক্যালরির ১০% পায় প্রোটিন থেকে, ১০% পায় ফ্যাট থেকে আর বাকি ৮০% পায় খাদ্যশস্য, শাকসবজি আর ফলমূল থেকে।

এই খাবার খেয়েই তারা পাঁচ দিনে প্রায় ৫০০ মাইল ছোটাছুটি করতে পারে এবং ১০০ পাউন্ডের একটা বোঝা ৭০ ঘণ্টায় ১১০ মাইল পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। ওদের শক্তির এ রকম আরো অনেক উদাহরণ আছে। ওরা মাসে প্রাণিজ প্রোটিন খায় গড়ে মাত্র একবার। চিকিত্‍সকরা পরীক্ষা করে দেখেছেন যে ওদের কোনোরকম হৃদরোগ নেই, ব্লাড প্রেশার নেই, ডায়াবেটিস নেই, আর নেই স্থূলতা।

Related Articles

Back to top button