চিকিৎসারোগ ব্যাধি

মৃগীরোগে রোগ হলে কি করবেন? জেনে নিন মৃগীরোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা

মৃগী একটি প্রচলিত রোগ। এ রোগের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি হয়, তাই চিকিৎসা গ্রহণের বিষয়ে সচেতন হওয়ার প্রয়োজন। এ বিষয়ে কথা বলেছেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের স্নায়ুরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. মো. জালালুদ্দিন।

প্রশ্ন: মৃগীরোগ কী এবং এর পেছনে কারণগুলো কী?

উত্তর: মৃগীরোগ মস্তিষ্কের একটি রোগ। আমরা যে কাজ করি, প্রতিটি কাজের জন্য মস্তিষ্ক থেকে একটি সিগন্যাল আসে। সে জন্য কাজগুলো আমরা করতে পারি। তবে মৃগীরোগে অযাচিত সংকেত আসে। সে জন্য শরীরের কোনো একটি অংশ বা সারা শরীরে একসঙ্গে কম্পন অনুভূত হয়, ঝাঁকি দেয়। এবং এ রকম হয় যে রোগী মাটিতে পড়ে যায়, খিঁচুনি হয়। এর পর অনেক সময় জিহ্বা কেটে যায়, প্রস্রাব হয়ে যায়। এই উপসর্গগুলো থাকলে কোনো পরীক্ষা ছাড়াই আপনি বলতে পারেন, লোকটি মৃগীরোগে ভুগছে।


প্রশ্ন: এর কি কোনো কারণ রয়েছে?

উত্তর: যেগুলো শিশু বয়সে হয়, এগুলোর মধ্যে মস্তিষ্কের ছবি তোলার বিভিন্ন পদ্ধতি আছে, যেমন—সিটি স্ক্যান অব দ্য ব্রেইন, এমআরআই। উন্নত মানের ইমেজিং পদ্ধতি রয়েছে, এতে কোনো কিছু পাওয়া যায় না। সেগুলোকে প্রাইমারি ইপিলিপসি বলে বা কারণবিহীন মৃগীরোগ বলা হয়।

আর ৪০ বা এর বেশি বয়সের মানুষের হঠাৎ খিঁচুনি হলো সেটার নানাবিধ কারণ থাকতে পারে। তার মস্তিষ্কে টিউমার থাকতে পারে। হয়তো তার স্ট্রোক হয়েছে, তার হঠাৎ করে খিঁচুনি হলো। একে সেকেন্ডারি ইপিলিপসি বা মৃগীরোগ বলে। তার একটি নির্দিষ্ট কারণ আছে এবং এটি সাময়িক। যে কারণের জন্য হচ্ছে, সেটি সংশোধন করার পর তার খিঁচুনি বন্ধ হয়ে যাবে।


প্রশ্ন: রোগী এলে আপনারা কীভাবে বাছাই করেন কোনটি প্রাইমারি, কোনটি সেকেন্ডারি এবং চিকিৎসা দেন কিসের ভিত্তিতে?

উত্তর: শিশু বয়সে আমরা ধরে নিই, এটি সম্ভবত প্রাইমারি ইপিলিপসি। মৃগীরোগীর জন্য রোগীর ইতিহাস রোগ নির্ণয়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেটি রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তার পর কতগুলো পরীক্ষা রয়েছে মস্তিষ্কের।

একটি হলো ইলেকট্রোইনকাফলোগ্রাম। এটা উপসর্গভিত্তিক রোগ নির্ণয়ে সাহায্য করতে পারে। আর একটি হলো বয়স্ক মানুষ যারা, তাদের জন্য মস্তিষ্কের ইমেজিং যেটা, সেটা প্রয়োজন হতে পারে। তবে এটাও ঠিক যে, অল্প বয়সে বা শিশু বয়সে মস্তিষ্কে টিউমার হতে পারবে না, সেটি নয়।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেটিও হতে পারে। সাধারণভাবে বলা হয়, ২০-এর ওপরে বয়স হলে মস্তিষ্কের এমআরআই করা প্রয়োজন। তবে তার নিচেও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের কাছে পরীক্ষা করে এবং তার বিবেচনার ওপর ভিত্তি করে করার প্রয়োজন হতে পারে।


প্রশ্ন: যখন একটি শিশুর প্রাথমিক মৃগীরোগ ধরা পড়ে তখন কী কী ধরনের উপসর্গ প্রকাশ পায়?

উত্তর: মৃগীরোগ হলে খিঁচুনি হয়, সারা শরীর বা একাংশ অজ্ঞান হয়ে যায় বা মাটিতে পড়ে যায়। এ ছাড়া মৃগীরোগের বহু উপসর্গ আছে, যেমন—কিছু কিছু মা এসে বলেন, আমার শিশুটি স্কুলে ভালো ছাত্র ছিল, হঠাৎ হঠাৎ সে আনমনা হয়ে থাকে। কেউ ডাকলে তখন সাড়া দেয় না। শিশুটি স্কুলে ভালো ছিল। তবে দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, এটি একটি সাধারণ ব্যাপার। তবে এটিও মৃগীরোগের একটি লক্ষণ। যদিও সে মাটিতে পড়ে যায় না, ওই সময় প্রস্রাব হয়ে যায় না। তবুও এটি মৃগীরোগ।


প্রশ্ন: এটি কয়দিন ধরে চলতে থাকে?

উত্তর: এটি শিশুদের হয় এবং একে ইংরেজিতে এবসেন্স সিজার বলে। যেমন—কতক্ষণ তার পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে কোনোরকম সম্পর্ক নেই। তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এই রকম। এতে তার স্কুলের কার্যক্রম খারাপ হয়ে যায়। এটি বাসায় থাকলেও হতে পারে। এটি একটি উপসর্গ যে, আপনার দিনে অসংখ্যবার হচ্ছে। ২০ বার বা ৩০ বার হচ্ছে। যাঁরা শিক্ষিত বা সচেতন মা, তারা ঠিকভাবে বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারেন এবং চিকিৎসকের কাছে যান। এটা ইপিলিপসি এবং এক ধরনের মৃগীরোগ।


প্রশ্ন: এ ক্ষেত্রে আপনাদের ব্যবস্থাপনা কী ধরনের হয়ে থাকে?

উত্তর: এসব বাচ্চার চিকিৎসা যথাসময়ে না দিলে তার মেধার বিকাশ ব্যাহত হতে পারে। স্কুলের যে কার্যক্রম, সেটি খারাপ হতে থাকে। যে ধরনের মৃগীই হোক, একটি অনুপস্থিতি ভাব বা আনমোনা থাকা বা মাটিতে পড়ে যায়। এসব ঘটনা ঘটার ফলে তাদের মস্তিষ্কের কোষের কিছু ক্ষতি হয়। চিকিৎসা ছাড়া থাকলে মেধা এবং বুদ্ধিমত্তা হ্রাস পায়।


প্রশ্ন: এর চিকিৎসা করেন কীভাবে?

উত্তর: যেসব রোগীর উপসর্গগুলো স্পষ্ট, সাধারণ মানুষ একেই মৃগীরোগ বলে। তবে আনমনা যেটি, সেটিকে সাধারণ মৃগী রোগ বলি না। আপনি জানেন, বাংলাদেশে মৃগীরোগ সম্বন্ধে অনেক কুসংস্কার আছে। মৃগীরোগ আছে—এ কথাটা অভিভাবকরা প্রকাশ করতে চান না। এ জন্য আমরা অনেক সময় বলি, এলাকায় গিয়ে তার মৃগীরোগ হয়েছে বলা দরকার কি, ইপলিপসি বলুন।

এ ক্ষেত্রে ইইজি পরীক্ষাটি খুবই সহায়ক হয়ে থাকে। এই রোগের বহুবিধ ওষুধ এখন রয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য ওষুধ বেরিয়েছে। ২০ থেকে ৩০ বছর আগে স্বল্প সংখ্যক ওষুধ ছিল। চিকিৎসা একটু দুরূহ ছিল। এখন চাইলেই এই সুবিধা যেকোনো রোগী নিতে পারেন।


প্রশ্ন: কত দিন ধরে চিকিৎসা চলতে থাকে?

উত্তর: এই চিকিৎসা খুবই দীর্ঘমেয়াদি এবং ব্যয়বহুল। এ কারণেই রোগীর আত্মীয়স্বজন একটু অনীহা প্রকাশ করেন। আরেকটি বিষয় হলো, চিকিৎসা শুরু করার অল্প সময়ের মধ্যে উপসর্গগুলো চলে যায় না। তাই রোগী এবং রোগীর অভিভাবককে বোঝানো প্রয়োজন। এবং চিকিৎসা গ্রহণের পর উদ্বুদ্ধকরণ খুবই প্রয়োজন।


প্রশ্ন: চিকিৎসা পুরোপুরি নেওয়ার জন্য কী ধরনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন?

উত্তর: তাদের আমরা বোঝানোর চেষ্টা করি বিভিন্ন রোগের মেয়াদ ভিন্ন। যেমন ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা তিন দিন বা পাঁচ দিন, টাইফয়েড রোগের চিকিৎসা ১৪ দিন, টিউবার কোলোসিসের চিকিৎসা ছয় মান বা নয় মাস। তবে মৃগীরোগের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সারা জীবনও প্রয়োজন হতে পারে। চিকিৎসা চালু করার পর যদি টানা তিন বছর কোনো উপসর্গ না হয়, তখন ধীরে ধীরে ওষুধ বন্ধ করা যায়।

ওষুধ শুরু করার পরই রোগটি বন্ধ হয়ে যায় না। ওষুধ শুরু করার পর এর মাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে। আরেকটি ওষুধ যোগ করতে হতে পারে। তিন বা ততোধিক ওষুধ শুরু করতে হতে পারে। এবং সুস্থতার খাতিরে এটি অবশ্যই মেনে চলতে হবে।

Related Articles

Back to top button