নারীর স্বাস্থ্য

বাচ্চা প্রসবকালে মা এর যত্ন

গর্ভকালে একজন প্রসূতির যত্ননেয়ার লক্ষ্য মাকে সুস্থ রেখে সুন্দর নবজাতক লাভ করা। এ উদ্দেশ্যে প্রসবকালীন যত্নকে আমরা তিনটি ভাগে ভাগ করতে পারি।

বাচ্চা প্রসবকালে মা এর যত্ন

১. প্রসবের প্রাথমিক বা ফার্স্ট স্টেজ অব লেবারের সময় যে প্রসবব্যথা শুরু হয়, তার লক্ষণগুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে দুটো কথা বলে নেয়া ভালো, বিশেষ করে যারা প্রথমবারের মতো মা হতে যাচ্ছেন, তাদের জন্য। প্রসবের ব্যথার লক্ষণগুলো হলো কোমর থেকে ব্যথা শুরু হয়ে তলপেটে আসবে, এর পর পুরো তলপেট শক্ত হয়ে উঠবে। ব্যথার তীব্রতা ক্রমেই বাড়বে এবং অন্তর্বর্তীকাল বা বিরতিকাল ক্রমেই অতিক্রম করবে। প্রথমে আধা ঘণ্টা অন্তর ব্যথা শুরু হয়ে পরে দুই বা তিন মিনিট অন্তর ব্যথা উঠবে।

জন্মদ্বারে রসক্ষরণ হবে, যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে বলে ‘শো’। এটি সামান্য রক্তমিশ্রিত হতে পারে। এটি সাধারণত পিচ্ছিল ও আঠালো হয়। এ সময় রোগিনীকে একটু হাঁটাহাঁটি করা ভালো। তবে কোনো রকম জটিলতা থাকবে তার জন্য বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

২. সেকেন্ড স্টেজ অব লেবার বা প্রসবকালের দ্বিতীয় পর্বে জরায়ুর মুখ পুরো খুলে যায় এবং সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। এ সময় প্রসূতিকে লেবার টেবিলে শোয়াতে হবে এবং একজন ডাক্তার বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মিডওয়াইফ দিয়ে প্রসব করাতে হবে। এ সময় সঠিকভাবে প্রসবকার্যটি সম্পাদন করতে না পারলে নবজাতক ও প্রসূতি উভয়ের প্রাণনাশের আশঙ্কা থাকে। প্রসূতির জন্মদ্বার ছিঁড়ে যেতে পারে। জরায়ু স্থানচ্যুত হয়ে সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসতে পারে। এমনকি জরায়ু ফেটে গিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে মা ও শিশুর মৃত্যু হতে পারে।

৩. থার্ড স্টেজ অব লেবার বা প্রসবের তৃতীয় পর্যায়ে গর্ভফুল মাতৃজঠরের বাইরে বেরিয়ে আসবে। এ সময় গর্ভফুল বের হতে দেরি হলে নানাবিধ জটিলতা দেখা দিতে পারে। সাধারণত আধা ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করা চলে। তবে জন্মদ্বারে রক্তক্ষরণ বা হেমারেজ বেশি হলে, যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে বলে পোস্টপর্টেম হেমারেজ, তাৎক্ষণিকভাবে গর্ভফুল বের করার ব্যবস্থা করতে হবে। নতুবা অত্যধিক রক্তক্ষরণে প্রসূতির মৃত্যুর আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। প্রসবের সময় যে বিষয়ে সতর্ক ও সজাগ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন, সেগুলো হলো

* প্রসবকালে দেখতে হবে গর্ভস্থ শিশুর পজিশন ঠিক আছে কি না, কারণ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় প্রসবব্যথা শুরু হওয়ার পরই কেবল রোগিনীকে ডাক্তারের কাছে আনা হয়।

* এরপর দেখতে হবে জন্মদ্বার স্বাভাবিক মাপ অনুযায়ী সাম্প্রসারিত কি না, চিকিৎসাবিজ্ঞানে যাকে বলা হয় কেফালো পেলভিক ডিসপ্লোপোরেশন অর্থাৎ জন্মদ্বার ও গর্ভস্থ মাথার মধ্যে আনুপাতিক বৈষম্য আছে কি না।

* প্রসব ব্যথার স্থায়িত্ব বিলম্বিত হচ্ছে কি না, চিকিৎসাবিজ্ঞানে বলে প্রোলংড লেবার। প্রসবব্যথা বিলম্বিত হলে এবং দীর্ঘসময় শিশুর মাথা জন্মদ্বারে এসে আটকে থাকলে প্রসূতি ও নবজাতক উভয়ই ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

* এরপর দেখতে হবে গর্ভস্থ শিশুর হৃদস্পন্দন সঠিক ও নিয়মিত আছে কি না। সঠিক বলতে আমরা বুঝি প্রতি মিনিটে ১৩০ থেকে ১৬০ বার এবং নিয়মিত কি না।

* প্রসবের প্রগ্রেস সঠিকভাবে হচ্ছে কি না। প্রতি আধা ঘণ্টা অন্তর প্রসবের অগ্রগতি পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন।

এখানে এক কথায় আমরা প্যাসেজ বলতে জন্মদ্বারকে বুঝি; প্যাসেঞ্জার বলতে নবজাতককে বুঝি; পাওয়ার বা শক্তি বলতে বুঝি যে শক্তিতে জরায়ু থেকে শিশু ভূমিষ্ঠ হয়। সুতরাং যদি আমাদের প্যাসেজ বা রাস্তা, প্যাসেঞ্জার বা নবজাতক এবং প্রসবব্যথার জোর বা শক্তি ঠিক থাকে এবং আমরা সুষ্ঠু ও সুচারুরূপে কাজটি করতে পারি তাহলে কোনো প্রকার জটিলতা ছাড়া একজন মাকে সুস্থ রেখে একটি সুস্থ নবজাতকের জন্মলাভ সম্ভব।

প্রসবোত্তর জটিলতায় কী করবেন :

১. গর্ভফুল মাতৃজঠরে আটকে গেলে এবং গর্ভফুল বেরিয়ে আসতে আধা ঘণ্টার বেশি সময় নিলে ধরে নিতে হবে গর্ভফুল জরায়ুর ভেতরে আটকে গেছে, এ অবস্থায় প্রসবকাজে সাহায্যকারিণী ডাক্তারের করণীয় হলো :

ক. সংক্রমণমুক্ত ও সম্পূর্ণ স্টেরিলাইজড অবস্থায় ক্যাথেটারাইজ করে মূত্রথলি বা ইউরিনারি ব্লাডার পুরোপুরি খালি করানো চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ক্যাথেটারাইজেশন ইন এসেপটিক ওয়ে।

খ. ক্যাথেটারাইজেশন করার পর আধা ঘণ্টা সময় অপেক্ষা করা যেতে পারেÑ গর্ভফুল মাতৃজঠরে গা থেকে সেপারেশনের উপসর্গগুলো প্রকাশ পায় কি না তা দেখার জন্য। এর উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে;

১. রোগিনীর তলপেটে চিনচিন ব্যথা অনুভব করা।

২. জন্মদ্বার দিয়ে অল্প তাজা রক্তক্ষরণ,

৩. গর্ভফুলের নাড়ি বা আমবিলিক্যাল কর্ড আস্তে আস্তে লম্বা হতে থাকে এবং

৪. তলপেটে জরায়ু বা ইউটেরাসের উচ্চতা একটি ছোট্ট বলের মতো দেখা যায়।

গ. গর্ভফুল সেপারেশনের উপসর্গগুলো দেখা দিলে গর্ভফুল প্রসবকারিণী ডাক্তার আমবিলিক্যাল কর্ড ধরে খুব সাবধানে নিচের দিকে ও পেছন দিকে সামান্য টান রাখতে হবে। তবে এ পদ্ধতির জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোক দরকার। যদি ব্রন্ট এন্ড্রাস মেথড ব্যর্থ হয় এবং যোনিপথে রক্তক্ষরণ শুরু হয়, তাহলে দুই এমপুল আরগোমট্রিন ইনজেকশন দিতে হবে ইন্ট্রাভেনাস এবং পটুনরায় ব্রন্ট এন্ড্রাস মেথডে চেষ্টা করতে হবে।

যদি আরো আধাঘণ্টা সময়ের মধ্যে গর্ভফুল বের হওয়ার কোনো লক্ষণই না দেখা যায়, তাহলে বুঝতে হবে

১. গর্ভফুল মাতৃজঠরের প্রয়োজনীয় সঙ্কোচন ও প্রসারণের অভাবজনিত কারণে বের হতে পারছে না। অথবা,

২. গর্ভফুল অস্বাভাবিকভাবে মাতৃজঠরের গায়ে আটকে আছে।

এ অবস্থায় রোগিনীকে ইন্ট্রাভেনাস স্যালাইন দিতে হবে, রক্তের গ্রুপ করে প্রয়োজনীয় রক্তের ব্যবস্থা করতে হবে এবং রোগিনীকে জেনারেল অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে গর্ভফুল ম্যানুয়েলি রিমুভ করতে হবে।

Related Articles

Back to top button