দৈনিক খবর

জাপানি দুই মেয়ের বাবার মামলা যে কারণে খারিজ করে দিলেন আদালত

জাপানি মা নাকানো এরিকো এবং বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত ইমরান শরীফের মামলার বিষয় রায় দিয়েছেন আদালত। তবে এই মামলা খারিজ করতে মানবিক বিষয়টি অধিক বিবেচনা করেছেন আডালত। মামলার নথিপত্র বিস্তারিতভাবে বিচার বিশ্লেষন করে দেখা যায়, জাপানি নারী নাকানো এরিকো ও ইমরান শরিফের মধ্যকার স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া, জাপানে অবস্থান করার মাধ্যমেতিন মেয়ের জন্মদান, তাদের জীবন পরিচালনার পেশা ও পারিবারিক জীবনের বিভিন্ন দিক এই মামলায় উঠে এসেছে।

রায়ে আদালত বলেন, জাপান থেকে আসা দুই শিশুর বাবা-মা উভয়েই বলেছেন, জাপানে অবস্থানকালে বড় নাবালিকা দুই মেয়ে পড়ালেখায় অত্যন্ত মেধাবী ছিল। তাদের রেজাল্ট খুব ভালো ছিল। তাদের বাবার দাবি, দুই সন্তানকে এদেশে আনার পর তিনি তাদের একটি প্রি-ক্যাডেট স্কুলে ভর্তি করেন। একই সময়ে তারা আমেরিকার একটি স্কুলে অনলাইনে পড়াশোনা করছিলেন। আদালত বলেছেন, বাবার ব্যক্তিগত চিন্তাধারা অনুযায়ী জাপানে অধ্যয়নরত দুই মেধাবী সন্তানকে নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষা প্রক্রিয়া থেকে আলাদা করার সিদ্ধান্ত যথাযথ নয়।

আদালত রায়ে আরও বলেন, জাপানের টোকিও পারিবারিক আদালতে মামলা চলাকালে মায়ের সম্মতি ছাড়াই বাবা দুই সন্তানকে এ দেশে নিয়ে আসেন। জাপানে একটি বিচারাধীন মামলার তথ্য গোপন করার সময় একই বিষয়ে একটি মামলা দায়ের করার সাধারণ যুক্তি গ্রহণ করা যায় না। এবং বিষয়টি নিঃসন্দেহে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের মানসিক বিকাশের জন্য মা”/রাত্মক এবং অপ্রতিরোধ্য বলে প্রতীয়মান হয়।

রায়ে ওই দম্পতির দুই মেয়ের মতামত তুলে ধরেন আদালত। বড় মেয়ে এটা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, তার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা জাপানে। বাবার বিরুদ্ধে তার কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে তাদের বাংলাদেশে আনা হয়। তার স্কুলের বন্ধুরা সবাই জাপানে থাকে। সে জাপান যেতে চায়। আদালতের রায়ে বলা হয়, জাপান ছাড়ার আগ পর্যন্ত তিন বোন একসঙ্গে ছিলেন। তারা এখনো আলাদা হতে চায় না। সেক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, তিন বোনকে তাদের স্বাভাবিক আবাসস্থল থেকে আলাদা করা তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে ভালো হবে না।

এ প্রসঙ্গে হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত তুলে ধরে আদালত বলেন, নাবালকদের হেফাজত নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাদের সার্বিক সুস্থতা গুরুত্বপূর্ণ। এই দম্পতির সমস্ত তথ্য পর্যালোচনা করে আদালত বলছে যে, জাপানি মা অন্য দশজন মায়ের মতো তার সন্তানদের দেখভাল করেন। বাবা বাড়িতে থেকে স্ত্রীর কাজে সহযোগীতা করতেন। তবে নাবালিকা কন্যাদের প্রাথমিক যত্নকারী হিসেবে জাপানি মায়ের তুলনায় বাবার কাছে তাদের হেফাজত অধিকতর কল্যাণকর, তা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন বাদী।

জাপানি নাগরিক এরিকো এবং বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইমরান ১১ জুলাই, ২০০৮ সালে বিয়ে করেন। তাদের তিনটি মেয়ে রয়েছে। ১৮ জানুয়ারী, ২০২১, ইমরান এরিকোর সাথে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করেছিলেন। এরপর ওই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি দুই মেয়েকে (জ্যেষ্ঠ ও মেজর) নিয়ে তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন। ছোট্ট মেয়েটি জাপানে।

নাকানো এরিকো ঢাকায় এসে ইমরানের কাছ থেকে দুই মেয়েকে ফিরিয়ে নিতে ২০২১ সালের ১৯ আগস্ট হাইকোর্টে রিট করেন। অপরদিকে, ছোট মেয়েকে ফেরত পেতে পৃথক রিট আবেদন করেন ইমরান। ওই বছরের ২১ নভেম্বর হাইকোর্ট পৃথক রিটের শুনানি শেষে দুই মেয়েকে তাদের বাবা ইমরানের হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। এরিকো এই আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করেন; যা চেম্বার আদালতের মাধ্যমে আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য আসে।

আপিল বিভাগ গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে এরিকের আবেদন (লিভ টু আপিল) নিষ্পত্তি করে একটি আদেশ জারি করে। আদেশে বলা হয়েছে, ঢাকার পারিবারিক আদালতে বিচারাধীন মামলা (মেয়ে দুটির বাবা ২০২১ সালে দায়ের করেছেন) নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জাপানের দুই মেয়ে তাদের মায়ের হেফাজতে থাকবে। তাদের বাবা তাদের সাথে দেখা করার সুযোগ পাবেন।

আদেশে আরও বলা হয়, মামলার পরিস্থিতি ও মেয়েদের স্বার্থ বিবেচনা করে তাদের এই আদালতের এখতিয়ারের বাইরে (দেশের বাইরে) নেওয়া যাবে না। আপিল বিভাগের আদেশের অনুলিপি পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে সংশ্লিষ্ট পারিবারিক আদালতকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আদালত এই দম্পতির বিষয়ে মানবিক দিকটি বিবেচনা করে ঐ মায়ের তিন মেয়ের বভিষ্যৎ বিবেচনা করে আদালত রায় দিয়েছেন। মামলাটি খারিজ করে দেওয়ার ঘোষনার পর ফের আপিল করার কথা বলেছেন ইমরানের আইনজীবি। তবে মেয়ে দুটিকে জাপানে নিতে কোনো বাধা রয়েছে কিনা সে বিষয়টি এখন ফের আপিলের ওপর নির্ভর করছে।

Related Articles

Back to top button