দৈনিক খবর

এক বিস্ফোরণে নিঃস্ব হলো তিনটি পরিবার

এবার মেয়ের মৃত্যুর দু’মাস পর সায়েন্সল্যাবের শিরিন ম্যানশনের বিস্ফোরণে মারা গেলেন বাবা আব্দুল মান্নান (৬৫)। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস দু’দিন আগে শুক্রবার বাদ জুম্মার পর আজিমপুর গোরস্থানে মেয়ের কবর জিয়ারত করতে গিয়েছিলেন মান্নান। আজ দু’দিন বাদে মেয়ের কবরের পাশে কবর খোঁড়া হচ্ছে তার জন্য। লায়রা প্রোডাক্ট (নিউ জেনারেশন) নামের ওই প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন আব্দুল মান্নান।

গত ৪ জানুয়ারি বাসায় অসুস্থ হয়ে পরলে মিটফোর্ড হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যায় তার ছোট মেয়ে মুনিয়া (১১)। মুনিয়া টিবি রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিল। মান্নান পরিবার নিয়ে লালবাগের ইয়াসমিন হাজি গলিতে বসবাস করতেন। দুই ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে সংসার ছিল। তাদের গ্রামের বাড়ি টঙ্গীর গাজীপুরা এলাকায়। দুই ছেলে আশিক আর শাকিল শোকে বিহ্বল। বোন হারানোর দু’মাসের মধ্যেই হারাতে হলো বাবাকে।

আশিক জানালেন, দুই মাস আগে হারিয়েছি ছোট বোনটাকে আর আজ বাবা চলে গেলেন নিজেই। আশিক বলেন, ‘বাবা লায়রা প্রোডাক্ট নামের প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করতেন বাবা। সর্বশেষ মার্কেটিং ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন। কিভাবে বাবার নিথর মরদেহটা মায়ের সামনে নিয়ে যাবো ভাবতেই সব গুলিয়ে যাচ্ছে।’

এদিকে রাতে হাসপাতালে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা হয় বিস্ফোরণে নিহত আব্দুল মান্নানের ভাতিজা মো. মিলনের সঙ্গে। তিনি বলেন: মুনিয়া মারা যাবার পর থেকেই চাচা মর্মাহত ছিলেন। গেল শুক্রবারও আজিমপুর কবরস্থানে মুনিয়ার কবর জিয়ারত করে এসেছেন। ভাগ্যের এমনই নির্মম পরিহাস যে এখন মেয়ের কবরের পাশেই স্থান হবে বাবার কবর।

শফিকুজ্জামান(৪৫) লায়রা প্রোডাক্টের কম্পিউটার অপারেটর । সকালে নাস্তা করে অফিসের উদ্দেশে বের হয়েছিলেন। স্ত্রী সন্তানরা ভাবতেও পারেননি এই যাত্রা শেষ যাত্রা। স্বামী কর্মস্থলে পৌছতে পেরেছেন কিনা জানতে ফোন করেন স্ত্রী পপি আক্তার। কিন্তু ফোন বন্ধ। একটু পরেই কর্মস্থলের এক সহকর্মী ফোন করে পপুলার হাসপাতালে আসতে বলেন, জানান অসুস্থ শফিকুজ্জামান।

ছেলে মেয়েকে ঘরে রেখেই পপুলার হাসপাতালে ছুটে আসেন পপি। স্বামী ক্ষতবিক্ষত মরদেহ দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন পপি। রাতে রাজধানীর ধানমন্ডিস্থ পপুলার হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, বাকরুদ্ধ অবস্থায় বসে আছেন শফিকুজ্জামানের স্ত্রী পপি আক্তার। রাজ্যের অসহায়ত্ব যেন ভর করেছে পপির মুখে। পাশেই বসা শফিকুজ্জামানের বোন পাপিয়া খানসহ আত্মীয়-স্বজনদের সান্ত্বনা দিতে দেখা যায় পপিকে।

বোন পাপিয়া বলেন, শফিকুজ্জামান-পপির ঘরে একছেলে এক মেয়ে। ছেলে আরিফুজ্জামান ক্লাস সেভেনে পড়ে, মেয়ে তৈয়বার বয়স মাত্র তিন বছর। এভাবে ভাইটা চলে যাবে ভাবতেই পারছি না, দুটো ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতেই মাথায় বাজ পড়ার দশা। স্বামীর পোড়া, মরা ক্ষতবিক্ষত শরীর দেখার পর থেকেই পপি কথাই বলছে না, কান্নাও করছে না। একদম নিথর স্তব্ধ নির্বাক হয়ে পড়েছে। কোনো কথাই বের করা সম্ভব হচ্ছে না।

হাসপাতালে এসে শুনি আমার ভাই আর নেই
সাদিকুর রহমান তুষার (৩৫) মার্কেটিং বিভাগে কাজ করতেন। তার বাড়ি নরসিংদী বেলাবো। স্ত্রী জেরিন ও চার বছরের শিশু কন্যা থাকে গ্রামের বাড়িতে।

পপুলার হাসপাতালে নিহত তুষারের বড় ভাই শফিকুর রহমান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, সকাল সাড়ে ১১ টার দিকে তুষারের নাম্বার থেকে তার স্ত্রী জেরিনের নাম্বারে আসা কলে জানানো হয়, ফোনটা ঘটনাস্থলে পড়েছিল, কিন্তু ফোনের মালিককে পাওয়া যাচ্ছে না। নাম খবর পেয়ে আমি খবর নিই, ছুটে আসি হাসপাতালে। এসে শুনি আমার ভাই আর নাই।

তিনি বলেন, ওর ঘরে স্ত্রী আর চার বছরের মেয়ে। তুষার ছাড়া পরিবারটি কিভাবে চলবে ভাবতে পারেন, সবকিছু দুঃস্বপ্ন লাগছে।

সোমবার লাশ পাবে পরিবার
বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত তিন ব্যক্তির লাশ রাত সাড়ে আটটার পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। এরআগে পপুলার হাসপাতালে নিহতদের সুরতহাল রিপোর্ট করা হয়েছে বলে জানায় পুলিশ। সোমবার সকালে সকল প্রক্রিয়া শেষে ঢাকা মেডিক্যাল থেকে পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হবে।

বিস্ফোরণের ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা নয়
বিস্ফোরণের ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা নয় বলে দাবি করেছেন নিউ জেনারেশন লিমিটেড স্কুল স্টেশনারি কোম্পানির মালিক আকরাম হোসেন।

তিনি বলেন, এখানে ফিনিক্স ইনসুরেন্সের অফিস থেকে বিস্ফোরণের সূত্রপাত। সেখানে কেন বিস্ফোরণ ঘটলো সেটা গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা দরকার। পাশাপাশি নিচেই ভবন লাগোয়া একটি ট্রান্সফরমার ছিল। সেটি থেকে আগুনের সূত্রপাত, আমরা বারবার সেটি সরানোর দাবি জানিয়েও সরাতে পারিনি।

আকরাম জানান, ৩৫ বছরের অফিস তার। কখনো এতো বড় শকট হতে হয়নি। অফিসে সাতজন কর্মীর মধ্যে ঘটনার সময় পাঁচজন ছিল। তাদের মধ্যে তিনজনই মারা গেছে।

শর্ট সার্কিট নাকি জমে থাকা গ্যাস বিস্ফোরণ
সকালে বিস্ফোরণের পর মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ড. খ. মহিদ উদ্দিন চার কারণে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে বলে জানান। একটি হলো শর্ট সার্কিট, জমে থাকা গ্যাস বিস্ফোরণ, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ও এসি বিস্ফোরণও হতে পারে । তবে এই মুহূর্তে সঠিক কারণ বলা যাচ্ছে না। তদন্ত শেষ হলে সঠিক কারণ জানা যাবে।

এরপরই দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক জানান ভবন বিস্ফোরণের ঘটনা নাশকতা নয়, দুর্ঘটনা। এরপর বিস্ফোরণের ঘটনাস্থলের পরিদর্শন শেষ এ তথ্য জানান ডিএমপি’র অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) ও সিটিটিসির বোম ডিসপোজাল দলের প্রধান রহমত উল্লাহ চৌধুরী বলেন, আমাদের কাছে প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে সাইন্সল্যাবের বিস্ফোরণের ঘটনাটি গত ২০২১ সালে ঘটে যাওয়া মগবাজারের বিস্ফোরণের মত গ্যাস থেকে সৃষ্ট একটি বিস্ফোরণ।

বিকেলে ঘটনাস্থলের পরিদর্শন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সেনাবাহিনীর ৫৭ ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানি কমাডিং অফিসার মেজর মো. কায়সার বারী জানান বিস্ফোরণের ঘটনায় বারুদ বা আইইডি’র আলামত পায়নি সেনাবাহিনী।

রোববার সকাল ১০টা ৫০ মিনিটের দিকে সাইন্সল্যাবের প্রিয়াঙ্গন শপিং মলের পাশের ভবন শিরিন ম্যানশনে এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।

Related Articles

Back to top button