দৈনিক খবর

শেষ পর্যন্ত না ফেরার দেশে সেই ‘নূর’, এখন তার নিথরদেহের অপেক্ষায় কেবলই কান্না

বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর হাজারো মানুষ একটি ভালো থাকার কারণে পাড়ি জমিয়ে থাকে বিদেশের মাটিতে। সেখানে থেকে কঠোর পরিশ্রম করে তারা তাদের কষ্টের টাকা পাঠায় দেশের মাটিতে তাদের পরিবারের কাছে আর সেই তাকে লাভবান হয় রাষ্ট্রও। কিন্তু অনেক সময় এই বিদেশে যাওয়ার বিষয়টি হয়ে দাঁড়ায় বেশ কষ্টকর। অনেকেই পরে থাকেন নানা ধরনের প্রতারকের খপ্পরে। যেমনটা হয়েছেন নূরের সাথে।

নূর আলমের স্বপ্ন ছিল উন্নত জীবনের আশায় ইউরোপে পাড়ি জমানো। স্বপ্ন পূরণে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার জন্য একটি দালাল চক্রের সঙ্গে আট লাখ টাকার চুক্তি করেন। কিন্তু টাকার দালালরা তাকে ইতালির বদলে লিবিয়ায় নিয়ে যায়। সেখানে তাকে বাড়িতে আটকে রেখে কষ্ট দেয় তাকে এবং দেশে তার পরিবারের কাছ থেকে ২২ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। তবে মোটা অংকের টাকা দিয়েও নূরের জীবন বাঁচাতে পারেনি তার পরিবার।

১২ ফেব্রুয়ারি তাকে শেষ করে না ফেরার দেশে পাঠানো হয়েছে বলে অভিযোগ করে তার পরিবার। এরপর থেকে তার নিথর দেহ লিবিয়ার মর্গে পড়ে আছে। তার নিথরদেহটি দেশে ফিরিয়ে আনার উপায় খুঁজতে মরিয়া পরিবার। এমন পরিস্থিতিতে নিথরদেহটি দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন অসহায় পরিবার।

নূরে আলম ফরিদপুরের সালথা উপজেলার মাজহারদিয়া ইউনিয়নের মাজহারদিয়া গ্রামের আব্দুল হালিম মল্যার ছেলে। তিনি তিন ছেলে ও এক মেয়ের জনক।

নুর আলমের বড় ভাই মো. সিরাজ মোল্যা অভিযোগ করে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, পাশ্ববর্তী বাখরদিয়া গ্রামের মোকছেম মোল্যার ছেলে দালাল চক্রের সদস্য মফিজ মোল্যা আমার ভাই নূর আলমকে ইতালিতে ভালো জীবনযাপনের প্রলোভন দেয়। তার সঙ্গে দালাল চক্রের অন্য সদস্যরা হলেন, একই গ্রামের সিরাজ মুন্সির লিটন মুন্সি, মাজারদিয়া গ্রামের আনার্দ্দি মল্যার ছেলে তোরাপ মোল্যা ও নগরকান্দার ধরন্দি গ্রামের খোরসেদ মল্যার ছেলে মিজান মোল্যা। তারা সবাই লিবিয়ায় থাকে।

তিনি আরও বলেন, গত বছর দুই মাস আগে নূর ইতালি নিয়ে যাওয়ার জন্য দালাল চক্রের সঙ্গে আট লাখ টাকার চুক্তি করে। গ্যাং লিডার মফিজ নূরকে দেশ ছাড়ার আগে ৪ লাখ টাকা এবং ইতালি পৌঁছানোর পর ৪ লাখ টাকা দিতে বলে। তার কথামতো নূর তাকে প্রথমে চার লাখ টাকা দেয়। পরে নূরকে লিবিয়া নিয়ে যান। তাকে প্রথমে লিবিয়ার বেনগাজির একটি বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে সমুদ্রপথে ইতালি নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দালালরা ইতালি নেয়ার পরিবর্তে লিবিয়ার একটি বাড়িতে কয়েকদিন আটকে রেখে তাদের ওপর নির্যাতন চালায়। সে দেশে পরিবারকে ডেকে পর্যায়ক্রমে টাকা পাঠাতে বলে। নূরকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে দালালরা টাকা চাইলে আমরা পাঠিয়ে দেই। মোট ২২ লক্ষ টাকা পাঠানো হয়েছিল।

এক পর্যায়ে নূর দেশে ফেরার উদ্যোগ নেন। কিন্তু নূর দেশে এসে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে এই আশঙ্কায় প্রথমে তাকে বাধা দেওয়া হয়। পরে দালালরা নূরকে আরো বেশি কষ্ট দিতে শুরু করে। নুর তাদের দেয়া কষ্টের কথা বারবার ফোনে বলে, তারা আমাকে শেষ করে ফেলার পরিকল্পনা করছে, তোমরা আমাকে বাঁচাও। পরে ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে তাকে ঘরে ঝুলিয়ে শেষ করে দেয়া হয়। ১৩ ফেব্রুয়ারি ওই দালালরা আমাদের ফোন করে জানায় নূর নিজেই নিজেকে শেষ করে দিয়েছে।

নুর আলমের ছেলে রসু মোল্যা ও মেয়ে মিতু আক্তার বলেন, আমাদের বাবাকে লিবিয়ার দালালরা শারীরিক কষ্ট দিয়ে শেষ করে ফেলেছে। এর আগে বাবাকে বাঁচাতে কয়েক দফায় দালালদের ২২ লাখ টাকা দিয়েছি। এই টাকা দিতে গিয়ে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমাদের সামান্য কিছু জমি বিক্রি করে ধারে টাকা পাঠিয়ে বাবাকে বাঁচাতে পারিনি। আমরা সেই দালালদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির দাবি করছি। একই সঙ্গে বাবার মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারের সহযোগিতা কামনা করছি।

তবে এ বিষয়ে অভিযুক্ত দালাল লিবিয়ায় অবস্থান করায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন।

প্রসঙ্গত, এ দিকে এই ঘটনা বাংলাদেশে নতুন নয়। এমন ঘটনা প্রায় ঘটে থাকে বাংলাদেশী প্রবাসীদের সাথে। সরকার থেকে এই সব ঘটনার সুরাহা করার কথা হলেও এখনো কোনো ধরণের স্থায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি এ বিষয় নিয়ে। এই ঘটনা নিয়ে সালথা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আক্তার হোসেন শাহিন বলেন, আমি আপনার মাধ্যমে নুর আলমের ঘটনা জানতে পেরেছি। নূরের পরিবার লিখিতভাবে কোনো ধরনের সহযোগিতা চাইলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আইন অনুযায়ী তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।

Related Articles

Back to top button