দৈনিক খবর

আইএমএফের যেন ঋণ পীড়াদায়ক: এক বছরে বাংলাদশের মানতে হবে কঠিন যেসব শর্ত

শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশকে ঋণ দিচ্ছে আইএমএফ। নানা জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে সংস্থাটি বাংলাদেশকে দিচ্ছে মোটা অংকের ঋণ। তবে এই ঋণ নেয়া বাংলাদেশের জন্য হচ্ছে না খুব বেশি একটা সহজ কাজ। তার কারণ এ জন্য বাংলাদেশকে মানতে হচ্ছে তাদের দেয়া বেশ কিছু কঠিন শর্ত।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭৬.২ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। ২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে এই পরিমাণ যোগ হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আইএমএফ অনুমোদিত ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাবে বাংলাদেশ। কিন্তু এই ঋণ পেতে বাংলাদেশকে পাঁচ ধরনের সংস্কার করতে হবে।

আগামী ৪২ মাসের মধ্যে বাংলাদেশকে ৪৭ বিলিয়ন ডলারের এই আর্থিক সহায়তা দেবে আইএমএফ। এই ঋণ পেতে বাংলাদেশ এই সময়ে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

আইএমএফ এবং বাংলাদেশ যে সংস্কারে সম্মত হয়েছে তা হল: আর্থিক সংস্কার, মুদ্রা ও বিনিময় হার সংস্কার, আর্থিক খাতের সংস্কার, জলবায়ু পরিবর্তন সংস্কার এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সংস্কার। ২০২৬ সাল পর্যন্ত এই সংস্কার কার্যক্রম চলমান থাকলেও আগামী এক বছরের মধ্যে কিছু কাজ জরুরি ভিত্তিতে করা হবে। করতে হবে

এই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন করা সংস্কারগুলি হল একটি কর রাজস্ব ব্যবস্থা গ্রহণ করা যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য বাজেট করা জিডিপির ৫.৫ শতাংশ অতিরিক্ত কর তৈরি করবে। আইএমএফের মতে, বিশ্বের সবচেয়ে কম কর-জিডিপি অনুপাতের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। কম কর আদায়ের কারণে প্রয়োজনীয় খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করা যাচ্ছে না। তাই আগামী জুনের মধ্যে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে আইএমএফ। আগামী বাজেটে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব উত্থাপন করতে হবে। আইএমএফ বলছে, অতিরিক্ত অর্থ পাওয়া গেলে অগ্রাধিকার খাতে বাংলাদেশ আরও বেশি ব্যয় করতে পারবে।

এ ছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের শুল্ক ও ভ্যাট বিভাগে কমপ্লায়েন্স রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ইউনিট গঠনের কথা বলা হয়েছে। এবং এটি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে করা উচিত। মূলত রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর জন্য আইএমএফ এই পরামর্শ দিয়েছে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যবহৃত অর্থের এক-চতুর্থাংশেরও কম অর্থ সঞ্চয়পত্র থেকে নেওয়া উচিত। সে লক্ষ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়কে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। প্রতি বছর সঞ্চয়পত্রের সুদ পরিশোধের জন্য সরকার বাজেটে বড় অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ করে থাকে। আইএমএফ চায় সরকার সঞ্চয়পত্রের ব্যয় কমিয়ে অগ্রাধিকার খাতে বেশি ব্যয় করুক। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারকে সঞ্চয়পত্র থেকে কম ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে হবে।

আইএমএফ পেট্রোলিয়াম পণ্যের দামের পর্যায়ক্রমিক সমন্বয়ের একটি স্থায়ী ব্যবস্থাও বাধ্যতামূলক করেছে। এটি ডিসেম্বরের মধ্যে করা উচিত। মূলত জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানোর জন্যই এই প্রস্তাব। এই পরামর্শের পিছনে যুক্তি একই – অগ্রাধিকার খাতে ব্যয় বৃদ্ধি।

সরকারি কোষাগারের টাকা জমার জন্য একটি ট্রেজারি সিঙ্গেল অ্যাকাউন্ট বা একটি একক ব্যাংক চালু করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে একটি নীতিমালা প্রণয়নের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এই কাজটি ২০২৩ সালের মধ্যে করা উচিত। আইএমএফ সরকারের নগদ ব্যবস্থাপনার উন্নতি এবং আর্থিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করার পরামর্শ দিয়েছে।

এ ছাড়া আগামী জুলাইয়ের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে সুদের হার করিডোর ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সুদের হার করিডোর হল এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সুদের হারের সীমা ধীরে ধীরে তুলে নেওয়া যায় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিগত হার কার্যকরী করা যায়। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা অনুযায়ী হিসাব করতে হবে। মূলত আইএমএফ ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের আসল হিসাব দেখানোর পরামর্শ দিয়েছে। এই কাজ জুনের মধ্যে করতে হবে। আইএমএফ বিশ্বাস করে যে এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বচ্ছতা এবং প্রতিবেদনের মান উন্নত করবে। এছাড়া একই সময়ের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

আইএমএফের শর্ত মেনে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জিডিপি হিসাব প্রকাশ করতে হবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি অর্থ বছরে একবার জিডিপি হিসাব প্রকাশ করা হয়। দাতা সংস্থাগুলির একটি দীর্ঘস্থায়ী পরামর্শ হল জিডিপি অনুমান আরও নিয়মিতভাবে প্রকাশ করা। ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জিডিপির পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি ও নীতিনির্ধারণী কার্যক্রম জোরদার হবে বলে মনে করে আইএমএফ।

এ ছাড়া ঝুঁকিভিত্তিক তদারকির কর্মপরিকল্পনার একটি পাইলট প্রকল্প আগামী জুনের মধ্যে শেষ করতে বলা হয়েছে। এটি একটি ঝুঁকি-ভিত্তিক ব্যাংকিং তদারকি ব্যবস্থা চালু করার লক্ষ্য রাখে। এবং সেপ্টেম্বরের মধ্যে, ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন ২০২০ এবং আর্থিক কোম্পানি আইন ২০২০ জাতীয় সংসদে পেশ করতে হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে ব্যাংকগুলোর খারাপ সম্পদের তথ্য প্রকাশের শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। এ তথ্য প্রকাশ হলে ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা বাড়বে বলে মনে করছে সংস্থাটি। আর এই কাজ জুনের মধ্যে করতে হবে।

রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) এর আওতায় বাংলাদেশ আইএমএফ থেকে ১.৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেয়েছে। চলতি বছরে বাংলাদেশকে এ ঋণের জন্য কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। ১২ মাসের মধ্যে যে শর্তগুলি পূরণ করা হবে তার মধ্যে রয়েছে একটি নীতি নথির বিকাশ এবং সেপ্টেম্বরের মধ্যে পাবলিক প্রকিউরমেন্টে সহযোগী কর্ম পরিকল্পনা। এই শর্তটি দেওয়া হয়েছে প্রধানত নিশ্চিত করার জন্য যে সরকারী ক্রয় জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি কমাতে এবং পরিবেশ রক্ষা করতে সহায়তা করে।

দ্বিতীয় শর্ত হলো, পেট্রোলিয়াম পণ্যের দাম পর্যায়ক্রমে সমন্বয় করতে হবে। সরকারি ব্যয়ের দক্ষতা বাড়াতে বর্ধিত ঋণ সুবিধার আওতায় এই শর্ত দেওয়া হয়েছে। এই কাজ ডিসেম্বরের মধ্যে করতে হবে।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে আইএমএফের দেওয়া তৃতীয় শর্ত পূরণ করতে হবে। দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নীতিমালা তৈরি করতে বলা হয়েছে। এই নীতির অধীনে, সংস্থাগুলিকে জলবায়ু-সম্পর্কিত ঝুঁকি সম্পর্কে রিপোর্ট করতে হবে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এ কাজ শেষ করতে হবে।

প্রসঙ্গত, আইএমএফ মূলত অর্থনীতিতে দুর্বল দেশের উপর সহায়তা করার জন্য সেই সব দেশগুলোকে ঋণ দিয়ে থাকে।আর এই তালিকায় এবার নাম লিখেছে বাংলাদেশও। এ করাও আইএমএফ এর কঠিন কঠিন সব শর্ত মেনে নিয়ে ঋণ নিয়েছে এশিয়ার আরেক দেশ পাকিস্তানও।

Related Articles

Back to top button