দৈনিক খবর

ভয়াবহ অবস্থার পথে নারায়ণগঞ্জ আ.লীগের বিভেদ, জানা গেল কারণ

নারায়ণগঞ্জের অন্যতম আলোচিত নেতা শামীম ওসমান। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এই আসনে নির্বাচন করে আসছেন এবং নারায়ণগঞ্জের এই আসনটিতে তার আধিপত্য রয়েছে। তাছাড়া শামীম ওসমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একজন প্রিয় পাত্রও। তবে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আইভি রহমান শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের অভিযোগ তুলে তার নেতিবাচক দিক তুলে ধরার চেষ্টা করেন। মাঝে মাঝে তার বিরুদ্ধে ও তার পরিবার নিয়ে মন্তব্য করে থাকেন।

নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের শান্তিপূর্ণ বিরোধ হঠাৎ করে উত্তাল হয়ে উঠেছে। গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বারবার ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানালেও এবার বিভক্তি ‘ভয়াবহ’ রূপ নিতে পারে বলে আশ”ঙ্কা প্রকাশ করেছেন সাধারণ কর্মী-সমর্থকরা। কারণ এবার কোনো ইস্যু বা কারণ ছাড়াই নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে বিরোধ শুরু হয়েছে।

তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী সংসদ সদস্য শামীম ওসমান গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর থেকে মেয়র আইভীর বিরুদ্ধে কোনো প্রকাশ্য সমাবেশ বা দলীয় বৈঠকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো মন্তব্য না করলেও মেয়র আইভী আবারও ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে ‘পুরনো কাসুন্দি’ ব্যবহার করেছেন। . শুধু তাই নয়, ‘নারায়ণগঞ্জের রাজধানী কুমিল্লা’ ও নারায়ণগঞ্জ জেলার নাম ‘ওসমান নগরী’ করা যেতে পারে বলে কটাক্ষ করেন আইভী।

শনিবার রাতে গুণীজন সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মেয়র আইভীর বক্তব্যে চরম ক্ষু”ব্ধ স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ কর্মীরা। তারা প্রকাশ্যে পদত্যাগের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলছেন, কেন্দ্র জানে বিএনপি ক্ষমতায় এলে শামীম ওসমানের ঠিকানা জেল না হয় কবর। আর কে আরও বেশি সুখে থাকবে সেটাও কেন্দ্র জানে। কেন্দ্র যখন সব জেনেও নীরব, তখন আমরা আর এই নোংরা খেলার খেলোয়াড় হতে চাই না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও নেতার নেতৃত্ব হৃদয়ে রেখে প্রয়োজনে পদত্যাগ করব।

জানা যায়, শনিবার রাতে ‘সাপ্তাহিক বিষের বাঁশি’ পত্রিকার ৩০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মেয়র আইভী বলেন, ভবিষ্যতে হয়ত এ রকম হতেও পারে- নারায়ণগঞ্জের রাজধানী কুমিল্লা হয়ে যায় কিনা। নারায়ণগঞ্জের নাম পরিবর্তন করে ওসমান নগরী করা হলে ভালো হতো। এ সময় তিনি প্রশাসনের সমালোচনা করে বলেন, তিনি চান প্রশাসন তার দায়িত্ব পালন করুক। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নারায়ণগঞ্জ শহর থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে কাজ করছেন না কেন?

ওসমান পরিবারের উদ্দেশে মেয়র আইভী বলেন, তাদের পূর্বপুরুষরা এখানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আসলে আমরা রাজার শাসনাধীন নিরীহ প্রজা। তিনি ৩০ বছর ধরে এই শহরকে জিম্মি করে রেখেছেন। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে প্রজারা এই রাজার অত্যা”/চার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলেছেন। আমরা কোনো রাজার রাজত্ব চাই না। তোমার শাসন মানি না। আমি এটা মেনে নেব না।

এদিকে মেয়র আইভীর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের মধ্যে চরম ক্ষো’ভের সৃষ্টি হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি চন্দন শীল বলেন, বেগম খালেদা জিয়া গোপালগঞ্জের নাম পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন বলে ক্ষো”ভ থেকে মেয়র আইভীও নারায়ণগঞ্জের নাম পরিবর্তনের কথা বলেছেন। তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে মেয়র আইভীর মন্তব্য থেকে বোঝা যায় এটি পর্দার অন্তরালের মিশনের সূচনা মাত্র। কারণ ২০০১ সালের পর শামীম ওসমানের নির্বাচনী এলাকা ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জে আওয়ামী লীগের কোনো কর্মী ঘরে ঘুমাতে পারেনি বলে নারায়ণগঞ্জ বিএনপির নেতৃত্বে যেই আসুক, আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে হ”/ত্যা করেছে এবং সর্বোপরি সে মেয়র আইভীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। বাকিটা দলের সভানেত্রী, তিনি নিশ্চয়ই সব জানেন।

নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু হাসনাত শহীদ বাদল বলেন, মেয়র আইভী বিএনপিকে খুশি করতে এমন বক্তব্য দিলেও বিএনপি কতটা খুশি হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ আমি বিশ্বাস করি, বিএনপি নিশ্চয়ই অতীত থেকে মেয়র আইভীর কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি দিয়েছে। কারণ তিনি বিএনপি, জামায়াত, সুশীল নাকি আওয়ামী লীগের- এ নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে তার নতুন বক্তব্যে ক্ষু”ব্ধ ও বিক্ষু”ব্ধ দলের নেতাকর্মীদের শান্ত করা কঠিন হবে বলে আমি মনে করি।

নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খোকন সাহা বলেন, কিছুদিন আগে আমাদের দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘দলের ভেতরই ষড়যন্ত্র চলছে, এরা দলের ভেতর ঘাপটি মেরে বসে অপকর্ম করে’। আমার মতো হাজার হাজার কর্মীও সেই ষড়য’ন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন। শামীম ওসমান বা তার ঐতিহ্যবাহী পরিবারের বিরুদ্ধে বিএনপি-জামায়াতের অন্তরে আশ্রয় নেওয়া কথাগুলো মেয়র আইভীর মুখ থেকে এসেছে, এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু সবকিছুরই সীমা আছে। তার নির্বাচন এলে শামীম ওসমানকে তার বড় ভাই বলে এবং নির্বাচনের পর তাকে গালাগালি করবে, কর্মীদের মূল্যায়ন তো দূরে থাকুক একটা সভা-সমাবেশ পর্যন্ত দলের জন্য করবেন না, বিএনপি-জামায়াত কিংবা দেশের বিরুদ্ধে যেসব সুশীলরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তাদের বিরুদ্ধে কথা বলবেন না। আমরা দলের বাইরের শত্রুর সঙ্গে লড়ব না ঘরের শত্রুর সঙ্গে- এভাবে যুদ্ধ করা যায় না।

অন্যদিকে দলের (ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ, নগর, বন্দর) তৃণমূল কর্মীদের সঙ্গে কথা বললে তারা শামীম ওসমানের প্রতি তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করে বলেন, তার প্রতি আমাদের সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ ভালোবাসা রয়েছে, এবং তার গভীর ভালোবাসা রয়েছে তার পরিবারের জন্য। শামীম ওসমানও সবসময় বলেন যে তিনি শেখ হাসিনার ‘ওয়ান মাস্টার ডগ’। যে নেতার নির্দেশে আমরা প্রতিটি নাসিক নির্বাচনে প্রার্থী হই সেই নেতা যখন তাকে এবং তার পরিবার সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করে তখন বিএনপি কর্মীরা আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করে। তিনি যদি আমাদের বার বার মাঠে নিয়ে আসেন এবং বারবার ছোট করেন তবে আমরা আর দল থাকব না।

নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের সময় মেয়র আইভী এবং শামীম ওসমানের মাঝে কিছুটা ঠান্ডা লড়াই বিরাজ করলেও, নির্বাচনের কয়েকদিন আগে থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে শামীম ওসমান আইভীর পক্ষ নিয়েই কাজ করেন। তবে নির্বাচনের পর মেয়র আইভী শামীম ওসমানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সমালোচনা করেন। যেটা সেখানকার স্থানীয় আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রশ্নের সৃষ্টি করে। তবে এই বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে থেকে এখন নির্দেশনা আসতে পারে, এমনটাই মনে করছেন সেখানকার স্থানীয় নেতাকর্মীরা।

Related Articles

Back to top button