শেখ হাসিনা ভারতের কাছে ‘দেশ বেচে’ দিয়েছে, এটা নিয়ে আগে কনফিউজিড ছিলাম,এক পরিষ্কার:নাজমুল
বাংলাদেশ এবং ভারতের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার শেষ নেই দুই দেশেই। আর এই আলোচনা অনেক সময় চলে যায় অনেক বড় বড় বিষয়কে ছাড়িয়ে। বিশেষ করে বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসলে ভারতের সাথে সম্পর্ক আরো গভীর এবং ঘনিষ্ট হয়ে ওঠে বলে সকলের ধারণা। এবার এ নিয়ে একটি বিশেষ লেখনী লিখেছেন নাজমুল আহসান।পাঠকদের উদ্দেশ্যে তার সেই লেখনী তুলে ধরা হলো হুবহু:-
আমরা যখন ছোটো ছিলাম তখন একটা কথা প্রায়ই শুনতাম বিএনপি বা ডানপন্থীদের মুখে: সেটা হলো আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা ভারতের কাছে ‘দেশ বেচে’ দিয়েছে। বিষয়টা অত্যন্ত কনফিউজিং ছিল। আফটার অল, দেশ আবার বিক্রি হয় কী করে!
পরবর্তীতে আমরা এই রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরের একটা কালচারাল ক্রিটিকের সঙ্গে পরিচিত হলাম। বলা হলো, অন্ধ ভারত বিরোধীতার নামান্তরই হলো দেশ বেচার আলাপ। এবং এই ক্রিটিকটা পুরোপুরি ভিত্তিহীন ছিল না। ওই সময় আওয়ামী লীগকে আরও কিছু ডিরেগেটোরি প্রচারণা সহ্য করতে হয়েছে। যেমন, শেখ হাসিনাকে ‘হিন্দুয়ানি’ হিসেবে তুলে ধরা; আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে মসজিদে শঙখ ধ্বনি বাজবে, ইত্যাদি দাবিও বিভিন্ন প্রচারণামূলক পোস্টারে আসতো।
কিন্তু দেখেন, দেশ বিক্রির আলাপটা রেথরিক বা বাগাড়ম্বর হতে পারে, তবে ধারণাগতভাবে এই আলাপটা অমূলক না। আর এটার সম্ভবত সবচেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো আদানির সঙ্গে করা বাংলাদেশের কয়লা বিদ্যুৎ চুক্তিটা।
এই চুক্তিতে আদানিকে বাংলাদেশ সরকার স্বার্বভৌম বা সভরেইন গ্যারান্টি দিয়েছে। বিপরীতে ২৫ বছর ধরে বাংলাদেশ কয়েক ডজন বিলিয়ন ডলারের বিদ্যুৎ কিনবে আদানির কাছ থেকে। সভ্রেইন গ্যারান্টি সরকারগুলো অনেক চুক্তিতেই দেয়; কিন্তু আদানির চুক্তিটা বেশ ট্রিকি।
মূল সমালোচনা হলো, আদানির কয়লার দাম অত্যন্ত চড়া আন্তর্জাতিক বাজার দর অনুযায়ী। আদানি ভারত সরকার থেকে বিভিন্ন কর ও শুল্ক ছাড় পাবে; প্লাস সম্পূর্ণ নিজস্ব সাপ্লাই চেইনের মাধ্যমে প্রচুর অর্থ সাশ্রয় করবে — কিন্তু চুক্তিতে তার প্রতিফলন ছিল না।
অস্ট্রেলিয়ার এক বিশেষজ্ঞ যিনি চুক্তির অনুলিপি পর্যালোচনা করেছেন, তিনি ডেইলি স্টারকে বললেন যে, চুক্তিটা যেন এরকম যে মুদ্রার এক পিঠ উঠলে আদানি পাবে; আরেক পিঠ উঠলে বাংলাদেশ পাবে না। আমরা যেমন খেলাতে টস করতাম এক টাকার পয়সা দিয়ে: ‘শাপলা অথবা মানুষ’। এই টসে শাপলা উঠুক আর মানুষ উঠুক, আদানি পাবে লাভের অঙ্ক; বাংলাদেশ পোহাবে ক্ষতি।
এই চুক্তিতে আদানির স্বার্থ এত সুদৃঢ়ভাবে সুরক্ষিত যে একটা সভরেইন বা স্বার্বভৌম দেশ হয়েও বাংলাদেশের পক্ষে একটা সামান্য প্রাইভেট কোম্পানির সঙ্গে করা চুক্তি থেকে বের হওয়া প্রায় অসম্ভব।
এই ধরণের অসম চুক্তি কেন হয়েছে তা নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে না। নরেন্দ্র মোদি ভারতের ক্ষমতায় আসা মাত্রই আদানির শৈণ শৈণ উন্নতি হয়েছে। ভারতের কুলীন বা পুরোনো বিলিয়নিয়ার ধনীদের টপকে খুব অল্প সময়েই গুজরাটের এই বণিক পরিবার এশিয়ার শীর্ষ ধনী কংলোমিরেটে পরিণত হয়। আর এর পেছনে ভারত রাষ্ট্রের সরাসরি সংশ্লেষ ছিল। মোদি যেই দেশ সফরেই গেছেন সেই দেশেই বিরাট বিরাট চুক্তি বগলদাবা করেছে আদানি, যেমনটা সম্প্রতি দেখিয়ে দিয়েছেন রাহুল গান্ধী। গতকালই সম্ভবত রিপোর্টার্স কালেক্টিভ আর আল জাজিরা দেখিয়েছে যে ভারতের সুগভীর সবুজ বনাঞ্চলে থাকা কয়লা খনির চুক্তি সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বাতিল হয়ে যাওয়ার পরও কেন্দ্রীয় সরকার ব্যাখ্যাতীত ব্যাতিক্রম দেখিয়ে আদানিকে খনি উপহার দিয়েছে। মোদি সরকারের সরাসরি সমর্থনে কয়লা খনি, সমুদ্র আর নদী বন্দর, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, জ্বালানি — কী হয়নি আদানির!
আর সেই মোদিকে তুষ্ট রাখতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রচণ্ড নির্লজ্জ্বের মতো একটা চুক্তি করেছে মোদির একনিষ্ঠ মিত্রের সঙ্গে। আর সেখানে দিয়ে আসা হয়েছে রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি, যা সভ্রেইন কোনো রাষ্ট্র ব্যাতির কোনো প্রতিষ্ঠান বা এনটিটি দিতে পারে না।
একেই হয়তো বলে ‘দেশ বেচে’ দেওয়া।
প্রসঙ্গত, এ দিকে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন অতি সন্নিকটে। আর এই কারণে বাংলাদেশ ভারতের সম্পর্ক আরো বেশি গভীর হচ্ছে বলে অনেকেই করছেন ধারণা। আবার অনেক আওয়ামীলীগ বিরোধীরা বলছেন এবারের নির্বাচন সহজ হবে না দলটির জন্য।