বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের টক অব টাউন এখন একটাই আর তা হলো মামুনুর রশিদ এবং হিরো আলম। সম্প্রতি দেশের বর্তমান সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মামুনুর রশিদ একটি কথা বলেছেন আর তা হলো তিনি বলেছেন যে, ‘ দেশে রুচির দুর্ভিক্ষ হয়েছে আর এই কারণে হিরো আলম এর মত মানুষের উত্থান হয়েছে। ‘ তার এই মন্তব্য নিয়ে এখন সারা দেশে চলছে বেশ তোলপাড়। এ নিয়ে সম্প্রতি একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন সোহাগ। পাঠকদের উদ্দেশ্যে তার সেই লেখনী তুলে ধরা হলো হুবহু:-
রুচির দুর্ভিক্ষ আচমকা আকাশ থেকে পড়ে না। প্রথমে খরায় বা বন্যায় রুচির উৎপাদন নষ্ট হয়। তারপর শুরু হয় দুর্ভিক্ষ। খরা এবং বন্যা মূলত তৈরি করে তারাই , যারা রুচির চাষ করে। তাদের তখন যথেষ্ট সময় নেই রুচি উৎপাদনের জমিকে উর্বর রাখার , তারা ব্যক্তিগত গোলার ফসল নিয়েই বা সাফল্য নিয়েই তখন তৃপ্ত।
হিরো আলম এখন সবাইর ভাজ। আপনি যখন কাউকে কিছু বলতে না পারবেন, কিন্তু বুকের ভেতর প্রচন্ড যন্ত্রণা থাকবে, তখন হিরো আলমকে কষে দুটো গাল দিয়ে দিবেন, দেখবেন আপনার উদ্দেশ্যও পূর্ণ হবে আর শহুরে প্যান্ট পরা ভদ্রলোকের দলও আপনাকে বাহবা দিতে শুরু করবে।
নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশিদ সাহেবও সম্প্রতি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের তৈরি এই প্রত্যয়কে নতুনভাবে হিরো আলমের জন্য ব্যবহার করেছেন। ফলত তিনি এখন নতুন টক অব দ্য বেকার মেইনস্ট্রিম মিডিয়া।
কথা হলো মামুনুর রশিদ সাহেবের মত মেইনস্ট্রিম সংস্কৃতি চর্চাকারীরা কী করেছেন গত কয়েক দশক? কতটা রুচির উৎপাদন ওনারা করেছেন?
নব্বইয়ের দশকেও এদেশে সিনেমার একটা মান ছিল। মানুষ তা দেখতো। টিভি নাটক অনন্য মাত্রার ছিল। শহুরে চাকুরিজীবী ভদ্রলোকদের বিনোদনের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল এসব টিভি নাটক। অফিস শেষ করে এসে সন্ধ্যায় পরিবার সমেত বসে টিভিতে নাটক দেখতো। কবিতা আবৃত্তি, গান চর্চা, যাত্রা নাটক সবকিছুরই একটা গ্রহণযোগ্য মাত্রা ছিল। ছুটির দিনে নাটক দেখতে নাটক পাড়ায় যেতো। মুক্তমঞ্চে বসে কবিতা আবৃত্তি শুনতো। আবার এসবের কারিগরদের নিয়ে নিজের ডায়েরিতে স্মৃতি রোমন্থন করতো।
তারপর?একটা সময় থেকে আমরা দেখলাম এখানে নেতৃত্ব দানকারী লোকেরা রাজনীতির নেতৃত্ব দেয়ার দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে। যেখানে প্রযুক্তির প্রভাবে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের বিনোদনগত চাহিদার পরিবর্তন হতে শুরু করলো, বিদেশেী কনেন্ট এসে একটা তীব্র প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করে দিল, তখন তার উপযোগী কন্টেন্ট তৈরি না করে তারা কেউ গেলো দলদাস হতে, কেউ চুপ করে ডুব দিল। অতীতের সফলতা গিলে বড় বড় ঢেকুর তোলাই সার। অর্থহীন কন্টেন্ট দিয়ে টিভি চ্যানেলগুলোর জন্য সস্তা সস্তা নাটক সিনেমা বানানো শুরু করার পর কেউ প্রতিবাদ করলো না। কেউ ভালো কিছু নিয়েও আসলো না। এক ইত্যাদি ছাড়া অন্যকোন অনুষ্ঠান নাগরিকের জন্য মানসম্মতভাবে রইলো না। ইত্যাদিও বৈচিত্র না আনায় আবেদন হারালো।
দেখা গেলো তারা নিজেরাই একটা গ্যাপ তৈরি করে দিল।তারা নাটকের মঞ্চ ছেড়ে কেউ কেউ রাজনীতির মঞ্চ কাঁপাতে শুরু করলো। আজকে তো দেখলাম একজন এলিট ফোর্সের ড্রেস গায়ে দিয়ে পুরান ঢাকায় ইফাতারী চেক করছেন। অবশ্য মাস্টার মশাই, ক্রিকেটার, ফুটবলার, ব্যবসায়ী, ডাক্তার সাহেব, আমলা, প্রকৌশলী, ঠিকাদার সবাই এখন রাজনীতিকেই বেশি লাভজনক পেশা মনে করে সে দিকে ঝুঁকছেন। রাজনীতির মত একটা গুরু দায়িত্বকে প্রকৃত রাজনীতিবিদদের জন্য সংকীর্ণ করে তুলছেন। সংস্কৃতিকর্মীরা বাদ যাবেন কেনো এ দৌড়ে। এই যে সংস্কৃতি কর্মীদের দলদাসে তৈরি হওয়ার ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, অথবা দেশ ছেড়ে বিদেশ চলে যাওয়া, পেশা পরিবর্তন করে ব্যবসায় লেগে যাওয়া, অর্থহীন কন্টেন্টে নাটক সিনেমা বানানোয় প্রতিবাদ না করার মৌণতা সেটাই দীর্ঘ সময় নিয়ে তৈরি করেছে এক অলঙ্ঘনী রুচির দুর্ভিক্ষ। আর সে জন্য ইউটিউবের এ যুগে মানুষ বিনোদনের মানসম্মত কিছু না পেয়ে ঝুঁকে পড়েছে বিকল্প ধারার দিকে। সে সুযোগটাই নিয়েছেন হিরো আলম।
তাই যতটা না রুচির দুর্ভিক্ষে হিরো আলমের উত্থান তার চেয়ে ঢের বেশি কার্যকর ছিল মামুনুর রশিদদের রুচিশীল ও মানসম্মত সংস্কৃতি চর্চায় ধারাবাহিক ব্যর্থতা। কিন্তু একালে এসে আঙ্গুল নিজের দিকে তাক করার মুরোদ না থাকায় গরীবের বউ হিরো আলমের দিকেই উঠলো।
আর মিডিয়াও সেটাকে লুটে নিল কারণ সাম্প্রতিক সময়ে হিরো আলম, পরীমনি, প্রভা, মুরাদ গং মানেই খবরের ভালো কাটতি। মিডিয়া অধিক ব্যবসা। মিডিয়াকে বলা হয় ফোর্থ স্টেট। আবার অনেকে বলেন মিরর অব দ্য নেশন। এটা যা দেখাবে জনগণ তাই রিফ্লেক্ট করবে। মিডিয়া যখন মেইনস্ট্রিম থেকে ছিটকে পড়েছে, ঠিক সে সময়টাই সোশাল মিডিয়া অনেকটা স্যাটায়ারিস্টিক ওয়েতে সে স্থান দখল করে নিয়েছে। পাঠকই এখানে সাংবাদিক। সাংবাদিকই এখানে পাঠক। ফলে জনস্রোত যে দিকে যায়, খবরও সেদিকে যায়। আবার বিপরীতটাও। খবরই জনস্রোত তৈরি করে।
সে যাক গে।হিরো আলম রুচির দুর্ভিক্ষ হলেও সাম্প্রতিক সময়ে হিরো আলম আর সে অবস্থানে নেই। বরং হিরো আলম টিকে গেছে। যদি সে একক ফ্যাক্টর রুচির দুর্ভিক্ষের সুযোগ নিয়ে পড়ে থাকতো তবে সে অনেক আগেই হারিয়ে যেতো। আমরা দেখেছি এরকম অনেকেই রুচির দুর্ভিক্ষ হিসেবে উঠে এসেছেন, যেমন সালমান মুক্তাদির বা অন্যরা। কিন্তু সে বা তারা এখন আর আলোচনায় সেভাবে নেই। বরং হারিয়ে যাচ্ছে। বিপরীতে হিরো আলম দিন দিন আরো অধিক শক্তিতে বিকশিত হচ্ছে।
এর কারণ হিরো আলম ঠিক সে জায়গাটাতেই দাঁড়িয়ে কথা বলছেন যে জায়গায় দাঁড়িয়ে মানুনুর রশিদদের কথা বলার কথা ছিল। একটা শূণ্য মঞ্চ পেয়ে সে ঠিক এমন কথাগুলোই বলছে যা দ্য ডিমান্ড অব দ্য কনটেম্পোরারী মোমেন্ট। নাগরিকের ঠিক চাওয়ার জায়গাটায় উচ্চারিত হচ্ছে তার বাক্য। এটা হতে পারে কখনো সমষ্টিগত নাগরিক আবার কখনো শুধু একজন। এবং এ অবস্থানে তিনি যতদিন থাকবেন, ততদিন একই ধারায় বিকশিতই হতে থাকবেন, যদি ভিন্ন কিছু না ঘটে। আর এই বিকাশটাই মামুনুর রশিদদের জন্য পীড়ার কারণ হবে। কারণ মঞ্চ হারানো কারোরই পছন্দ নয়।
তবে এটা জাতির জন্য খুবই খারাপ হবে। কারণ হিরো আলম জাতীয় ডিমান্ড পূরণ করার মত সক্ষম ব্যক্তি নন। তার সেই কমিটমেন্টও নেই। তাকে এখানে দীর্ঘ সময় থাকতে দেয়াও ঠিক হবে না। অবশ্যই জোর করে বিদায় করে নয়, বরং যোগ্যদেরই এখানে আসতে হবে, দাঁড়াতে হবে, কথা বলতে হবে। এবং তারা যতদিন এটা না করবে, একটা মেঘ ঈশান কোনে জমেই থাকবে। বৃষ্টি হয়ে নামবে না। আবার কেটেও যাবে না।
প্রসঙ্গত, এ দিকে মামুনুর রশিদের এই মন্তব্য নিয়ে এখন দেশে শুরু হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। আর তার এই কথার জবাব দিয়েছেন হিরো আলমও। তবে অনেকেই এই বিষয়টিকে দেখছেন নেতিবাচক হিসেবে। হিরো আলমকে এখানে ছোট করা হয়েছে বলেই দেখছেন অনেকে।