জেনে রাখুন

সাপ দেখলেই মারবেন না! সাপের বেশে অনেক সময় জিন ও থাকতে পারে

সাপ সরীসৃপ প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত লম্বা বেলনাকার পাবিহীন এক মেরুদণ্ডী প্রাণী। এদের দেহ আঁশ দ্বারা আবৃত। মানুষের আবাসস্থল বাড়ি, গভীর জঙ্গলের মাটি ও মাটির নিচে গর্তে বা সুড়ঙ্গে, গাছে ও পানিতে সাপের বসবাস। সাপ বছরে কয়েকবার খোলস বদলায়। এদের কোনো বহিঃকর্ণ নেই। সে জন্য এরা বায়ুবাহিত শব্দ নিখুঁতভাবে গ্রহণ করতে পারে না। তবে মাটি বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে এরা অন্তঃকর্ণ গ্রহণ করতে পারে। সাপের কান ও চোখের পাতা নেই। চোয়ালের দুই অংশের হাড় নমনীয় অস্থিবন্ধনী দিয়ে যুক্ত থাকায় শিকার গেলার সময় চোয়ালের প্রতি অর্ধাংশ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। সাপকে ভয় পায় না এমন মানুষের সংখ্যা একেবারেই হাতেগোনা। কেননা এটি শুধু ভীতিকর প্রাণীই নয়, বরং প্রাণসংহারীও। প্রতিবছর অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ঘটে এর বিষাক্ত ছোবলে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, সাপ আমরা যতটুকু ভয় পাই, সাপ তার চেয়ে শতগুণ বেশি ভয় পায় আমাদের। সে জন্যই দেখা যায়, মানুষের উপস্থিতি টের পেলে সাপ খুব দ্রুত পলায়ন করে। অনেকেই অবাক হবেন, এই প্রাণসংহারী সাপ মানুষের পরম উপকারী বন্ধু। যে সাপের ভয়ে মানুষ জড়সড়, যে বিষের কারণে মানুষের প্রাণহানি ঘটে, সেই সাপ আর সাপের বিষই মানবদেহের রোগ নিরাময়ের অন্যতম প্রতিষেধক। সম্প্রতি সাপ নিয়ে উন্নত বিশ্বের গবেষণাগারে এটা প্রমাণিত হয়েছে, ক্যান্সার নিরাময়ে সাপের বিষ এক অনন্য নিয়ামক। ব্যাঙ্গোর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. উলফগ্যাং উস্টার জানান, ‘বিষধর সাপের বিষ মানুষের নানা জটিল রোগের প্রতিষেধক। ’ ফ্রাংকফুর্টের জীবরসায়নবিদ ইয়োহানেস এবলে বলেন, ‘সাপের বিষ হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। ’

উন্নত বিশ্বের ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, অস্ট্রিয়াসহ যেসব দেশ রাসায়নিক মৌল বা যৌগ উপাদান তৈরি করে, সেসব দেশে এক আউন্স সাপের বিষের দাম হচ্ছে কোটি টাকা। এ ছাড়া সাপ আমাদের আরো অনেক উপকার করে থাকে। যেমন—ফসলি জমির ইঁদুর ও পোকামাকড় খেয়ে কৃষকের ফসল অনিষ্টতার হাত থেকে রক্ষা করা, মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করা ইত্যাদি। তা ছাড়া সাপের চমত্কার কারুকার্যময় চামড়া দিয়ে তৈরি করা হয় নানা রকম শৌখিন জিনিসপত্র।

পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় তিন হাজার প্রজাতির সাপ আছে। এর মধ্যে প্রায় ৫০০ প্রজাতির সাপ বিষধর। বাকি সবই নির্বিষ। আমাদের বাংলাদেশেই রয়েছে প্রায় ১০০ প্রজাতির সাপ। এর চার ভাগের তিন ভাগই নির্বিষ। এদের মধ্যে সহজে দেখা যায় এমন সাপ হচ্ছে—ঢোঁড়া, ঘরগিন্নি, কুকরি, মেটে সাপ, দুধরাজ সাপ, ফণীমনসা, পাইন্যা বা পানি সাপ, দাঁড়াশ, অজগর, গোখরো ও কিছু সামুদ্রিক সাপ।

ইসলামী দৃষ্টিতে সাপ দেখা এবং মারা

আমাদের একটা নিন্দনীয় স্বভাব হলো, সাপ দেখলেই তা মেরে ফেলা। এ কথা সত্য যে সাপ একটি প্রাণসংহারী প্রাণী। পৃথিবীতে এমন সাপও আছে, যার এক ফোঁটা বিষ এক মিনিটের মধ্যে একাধিক মানুষের প্রাণনাশে সক্ষম। কিন্তু সব সাপ বিষধর নয়। তা ছাড়া বেশির ভাগ সাপ কেউ উত্ত্যক্ত না করলে সহসা কামড় বসায় না। তার পরও সাপের দ্বারা ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে তা মারতে বাধা নেই। তবে সাপ মারার আগে আমাদের করণীয় হলো ওই সাপ আমাদের ক্ষতি করবে কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া। এ ব্যাপারে হাদিসেও খুব সুন্দর নিয়ম উল্লেখ রয়েছে। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘কোনো সাপ মারার আগে তিনবার তাকে সাবধান করবে। এর পরও যদি সে (গর্ত থেকে) বের হয়, তখন তাকে মেরে ফেলবে। কেননা সে শয়তান। ’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৫১৬৮)

হজরত সালিম (রহ.) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা সেই সাপ মারবে, যার পিঠে দুটি সাদা রেখা আছে এবং যার লেজ নেই। কেননা এরা বিষধর হওয়ার কারণে দর্শনশক্তি বিনষ্ট করে দেয় এবং গর্ভস্থিত সন্তান ধ্বংস করে দেয়। ’ বর্ণনাকারী বলেন, এর পর থেকে আবদুল্লাহ (রা.) যেকোনো সাপ দেখতে পেলে তা মেরে ফেলতেন। একবার আবু লুবাবা (রা.) অথবা জায়েদ ইবনে খাওয়াব (রা.) তাঁকে একটি সাপ মারতে উদ্যত দেখে বললেন, নবী করিম (সা.) ঘরে বসবাসকারী সাপ মারতে নিষেধ করেছেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ৫১৬২)

সাপ দেখলেই মারবেন না! সাপের বেশে অনেক সময় জিন ও থাকতে পারে

অনেক সময় সাপের রূপ ধারণ করে নেককার জিনরা বিচরণ করে থাকে। যেমনটি হাদিস থেকেও জানা যায়। হজরত ইয়াজিদ ইবনে মাওহাব (রহ.) আবু সাইদ (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন—একদা আমি আবু সাঈদ খুদরি (রা.)-এর কাছে এসে বসি। এ সময় আমি তাঁর চৌকির নিচে কিছুর আওয়াজ শুনতে পাই। আমি তাকিয়ে দেখি যে একটি সাপ। তখন আমি দাঁড়ালে আবু সাইদ (রা.) জিজ্ঞাসা করেন, তোমার কী হয়েছে? তখন আমি বললাম, এখানে একটা সাপ আছে। তিনি বলেন, তুমি কী করতে চাও? তখন আমি বললাম, আমি তাকে মেরে ফেলব। তখন তিনি তাঁর বাড়ির একটি ঘরের দিকে ইশারা করে বলেন, এখানে আমার চাচাতো ভাই থাকত। খন্দকের যুদ্ধের সময় সে রাসুল (সা.)-এর কাছে ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য অনুমতি চায়। কেননা সে তখন নতুন বিয়ে করেছিল। তখন রাসুল (সা.) তাকে অনুমতি দেন এবং বলেন, তুমি তোমার হাতিয়ার নিয়ে যাও। সে নিজ ঘরে ফিরে তার স্ত্রীকে ঘরের দরজার ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে তার (স্ত্রীর) প্রতি কলম দিয়ে ইশারা করে। তখন তার স্ত্রী বলল, তাড়াহুড়ো কোরো না। এসে দেখো কী যেন আমাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। তখন সে ঘরে ঢুকে একটি কুিসত সাপ দেখতে পায়। সে তাকে বল্লম দিয়ে হত্যা করে এবং বল্লমে তার দেহ ফুঁড়ে বাইরে নিয়ে আসে।

বর্ণনাকারী বলেন, আমি জানি না, এরপর কে আগে মারা গিয়েছিল—লোকটি, না সাপটি। তখন তার জাতির লোকেরা রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে বলেছে, আপনি দোয়া করুন, যাতে আমাদের সঙ্গী বেঁচে যায়। তখন নবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা তার মাগফিরাতের জন্য দোয়া করো। ’ এরপর তিনি বলেন, ‘মদিনার একদল জিন ইসলাম গ্রহণ করেছে, তাই তোমরা যখন তাদের (সাপ) কাউকে দেখবে, তখন তাকে তিনবার ভীতি প্রদর্শন করবে যে আর বের হবে না, অন্যথায় মারা পড়বে। এরপর যদি সে (গর্ত থেকে) বের হয়, তখন তাকে মেরে ফেলবে। ’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৫১৬৭)

তাই আসুন! সাপ দেখামাত্রই না মেরে নবীজির এই হাদিসের অনুসরণ করি। অযথা এদের উত্ত্যক্ত না করি। সাপকে সাপের মতোই বেড়ে উঠতে দিই। কারণ এরাও আমাদের জীববৈচিত্র্যের অন্যতম অংশীদার। পরিবেশ রক্ষায় এদের ভূমিকাও অনস্বীকার্য।

Related Articles

Back to top button