চিকিৎসাজেনে রাখুনরোগ ব্যাধি

টনসিল বা গল-গ্রন্থির প্রদাহ লক্ষন ও চিকিৎসা সম্পর্কে জেনে নিন

টনসিলের সমস্যার কারণে গলাব্যথায় ভুগে থাকেন অনেকে। যদিও টনসিলের সমস্যা সব বয়সেই হয়ে থাকে তারপরও শিশুদের ক্ষেত্রে টনসিলের ইনফেকশন একটু বেশি হয়। টনসিলের এই ইনফেকশনকে চিকিত্সাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় টনসিলাইটিস বা টনসিলের প্রদাহ।

টনসিল কি ?

জিহ্বার শেষপ্রান্তে, আলজিহ্বার নীচে বাম ও ডানপাশে বাদামের মতন ১.৫ সেন্টিমিটারের মত আকারে লালবর্ণের মাংসপিন্ডকে টনসিল (Tonsil) বলা হয়ে থাকে। টনসিল দেখতে মাংসপিণ্ডের মতো মনে হলেও এটি লসিকা কলা বা লিম্ফয়েড টিস্যু দিয়ে তৈরি। মুখগহ্বরের দু’পাশে দুটি টনসিলের অবস্থান । মুখ, গলা, নাক কিংবা সাইনাস হয়ে রোগজীবাণু অন্ত্রে বা পেটে ঢুকতে বাধা দেয় এই টনসিল অর্থাৎ টনসিল শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে। ( তারপর ও আছে আর ৩২৮ টি গ্রন্থি )।

টনসিলাইটিস (Tonsillitis)

আর টন্সিলাইটিস হচ্ছে টনসিল সমূহ যখন ব্যাকটেরিয়া , ভাইরাস বা ছত্রাকের সংক্রমণ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে প্রদাহের বা ইনফেকশনের সৃষ্টি করে ভিন্ন সমস্যা দেখা দেয় । জন্ম থেকেই গলার মধ্যে এই টনসিল থাকে এবং বাচ্চাদের বেলায় টনসিল আকারে বড় দেখা যায় পর্যায় ক্রমে ( ৫-৬ বছর বয়সের মধ্যে এটি সবচেয়ে বেশি বড় আকৃতিতে পৌঁছায় ) , বয়স বাড়ার সাথে সাথে টনসিল ক্রমান্বয়ে ছোট হতে থাকে।

টনসিলের প্রদাহ বেশির ভাগ বর্ষায় বেশি হয় । শীত কালে ও টনসিল প্রদাহ হলে ও খুভ কম এবং ৮৫% ভাইরাস সংক্রামণ জাতীয় ।( যাদের শরীরে ইমিউনিটি শক্তি কম বা ঠাণ্ডা সহ্য ক্ষমতা কম তাদের বেলায় ভাইরাস সমূহ বেশি আক্রান্ত করে।

টনসিলাইটিস সাধারণত দুই ধরনের হয়।

১) একটা হলো তীব্র বা একিউট। ২) অন্যটি হলো দীর্ঘমেয়াদি বা ক্রনিক টনসিলাইটিস।

লক্ষণ

১) টনসিলের ইনফেকশন হলে মূলত গলা ব্যথা হবে, গিলতে অসুবিধা হবে। শরীরে সামান্য জ্বর থাকবে  জ্বরের মাত্রা ৩৯ সেলসিয়াস =১০৩ ফারেনহাইট = অথবা এর বেশীও হতে পারে। অনেক সময় গলার স্বর পরিবর্তিত হয়, নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ থাকে। সঙ্গে শিশুর খাবার গ্রহণে অনীহা কিংবা নাক দিয়ে পানি ঝরা ইত্যাদি থাকতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে গলার বাইরে দিকে গ্রন্থি ফুলে যেতেও দেখা যায়।

২) ভাইরাসজনিত টনসিলাইটিসে টনসিলের প্রদাহ ধীরে ধীরে বাড়ে, ফলে উপসর্গগুলোও ধীরে ধীরে আবির্ভূত হয়। অন্যদিকে ব্যাকটেরিয়াজনিত টনসিলাইটিস হঠাৎ করেই তীব্রভাবে আক্রমণ করে। ফলে উপসর্গ সমূহ এবং -গলাব্যথা , ব্যাদনা জ্বালা পোড়া ইত্যাদি হঠাৎ করেই দেখা দেয়।

৩) শিশুদের বেলায় বমি, পেটে ব্যথা বড়দের বেলায় মাথাব্যথাও থাকতে পারে। ৫ বছরের কম বয়েসীদের বেলায় ডাইরিয়া সহ খাওয়া দাওয়ায় অরুচির লক্ষণ পাওয়া যায় সেই সাথে সকলের ই কম বেশি কাশিও হতে পারে।

৪) অ্যাকিউট টনসিলাইটিসের লক্ষণ: ঠাণ্ডা- সর্দি, অত্যধিক জ্বর বা জ্বরের সাথে কাঁপুনি ,গলাব্যথা খুসখুসে কাশি,খাবার গিলতে বা পানি পান করতে ব্যাথা , নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা,মুখের ভেতরে টনসিল বেশ লালচে বর্ণ ধারণ করে , টনসিলের ওপর হলুদ বা সাদা আস্তরণ পড়তে পারে, গলার ভেতর এর আশপাশের অন্যান্য লসিকাগ্রন্থিও ফুলে যাওয়া অথবা গলায় ও মাড়িতে ব্যাথা ইত্যাদি।

৫) ক্রনিক টনসিলাইটিসের লক্ষণ: জিনিসের গন্ধ পাওয়া যায় না, জোর করে ঘ্রাণ নিতে গেলে সবকিছুতেই বাজে গন্ধ পাওয়া যায়।, ঘুমাতে খুব অসুবিধা হয়। শিশু ঘুমাতে ভয় পায় , নাক ডাকার সমস্যা হতে পারে , অনেক সময় বাচ্চার ঘুমের ধরন পাল্টে যায়। থুতনি এগিয়ে আসে , মাথাব্যথা, গলায় ঘায়ের কারণে ব্যথা, কানে ব্যথা, ক্লান্তিময়তা, মুখে অনবরত লালা জমতে থাকে, খাবার খেতে কষ্ট ও মুখ হাঁ করতে অসুবিধা হয় , মুখ দিয়ে লালা বের হয় ও কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে যেতে পারে, মুখ থেকে দুর্গন্ধ বের হতে পারে।

রোগ শনাক্ত /রোগ নির্ণয়ঃ

টাং ডিপ্রেসর ( মুখ খোলার এক ধরণের ফরসেপ বিশেষ ) দিয়ে জিবকে চেপে ধরে ভেতরে প্রদাহ আছে কি না দেখে বোঝা সহজ যে টনসিলাইটিস হয়েছে। প্রদাহেরকারণে টনসিল বড় ও লালাভ হয়ে থাকে। টনসিলের উপর হলুদাভ বা ধুসর আবরণে টনসিল আংশিকভাবে আবৃত থাকে।

টনসিলাইটিস নির্ণয়ে বিশেষজ্ঞের এই পর্যবেক্ষণই যথেষ্ট। তারপর ও নিম্নের দুটি পরীক্ষার দ্বারা নিশ্চিত হতে পারেন আপনার কোন ধরণের টন্সিলাইটিস হয়েছে । ভাইরাস জনিত হলে ভাইয়াস সেন্সিটিভিটি কালচার করাতে পারলে বুঝে নিতে পারবেন কোন ধরণের ভাইরাস আক্রমের জন্য বেশি দায়ি।

১) rapid strep test ( এ পরীক্ষার দ্বারা গলার ভিতরের ইনফেকশনের উপরের ঝিল্লির মিউকাস পরীক্ষা করে মাত্র ৭ মিনিটে নিশ্চিত হওয়া যায় ইহা স্ট্রেপটোকোকাস ব্যাক্টোরিয়ার দ্বারা আক্রান্ত কিনা -)

২) strep culture ( পরীক্ষাগারে স্ট্রেপটোকোকাস কালচার করা কে বলা হয় – মনে রাখবেন এই সব পরীক্ষার আগে কোন জাতীয় এন্টিসেপটিক মাউথ ওয়াস ব্যাবহার করা নিষেধ )
এ ছাড়া ও যদি মনে হয় গলার কাছে কিছু আটকে থাকছে, সঙ্গে শ্বাসকষ্ট, গলার আলট্রাসোনোগ্রাফি করে দেখা ভাল সেই সাথে আপনার চিকিৎসক অন্য ধরণের জটিলতা বুঝতে রক্তের হিমোগ্লোবিন, টিসি, ডিসি, ইএসআর ও প্রয়োজনে এসও টাইটার পরীক্ষা করার কথা বলতে পারেন বা ডায়াবেটিস থাকলে সঙ্গে ব্লাড সুগার টেস্ট এবং ডিএসএইচ পরীক্ষা করার কথা বলতে পারেন ।

বিদ্রঃ টিবি সন্দেহ হলে বুকের এক্সরে, রক্তের টিবি পিসিআর ও কফ কালচার ফর এএফবি করালে সাথে সাথে ধরা পড়বেই এবং টিউমার বা ক্যানসার জাতীয় কিছুর সন্দেহ হলে জিআই এন্ডোস্কোপি ও ফাইবার অপটিক ল্যারিঙ্গোস্কোপি করে অথবা প্রয়োজনে টিউমার থেকে টিস্যু তুলে তার বায়োপ্সি করে রোগ নির্ণয় নিশ্চিত হতে পারেন আপনার চিকিৎসক।

টনসিলাইটিসের চিকিৎসা দুই ভাবে করা যায়
১. ওষুধ সেবন
২. অপারেশন

টনসিলের চিকিৎসা নির্ভর করে কারণের ওপর। যদি ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়ে থাকে তাহলে ভাল চিকিৎসকের পরামর্ষে একটু উন্নত অ্যান্টিবায়োটিক ( এমোক্সিসিলিন, সিফিউরোক্সাইম বা আর উন্নত গ্রোফের ঔষধ ) ঔষধ সঠিক নিয়মে সেবন করলে মাত্র ৭ দিনে ১০০% নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় টনসিলের প্রদাহ ভাল হয়ে যাবে ।

এখানে একটা বিষয় মনে রাখবেন বর্তমানে আধুনিক চিকিৎসায় অনেক উন্নত ধরণের এন্টীবায়োটিক আছে যার সঠিক সিঙ্গেল ডোজেই ভাল হয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু তা না করে যদি নিজের ইচ্ছা মত ২/৪ টা ক্যাপস্যুল বড়ি খেয়ে ভাল হয়ে জান এবং ইহা আবার পুনরায় আক্রমণ করে এবং সে সময় ও এই রকম করেন ৯৫% বেলায় পরবর্তীতে অপারেশন করানো ছাড়া আর বিকল্প কোন পথ নেই – তাই ব্যাক্টোরিয়ার কারণে ইনফেকশন মনে করলে সম্পূর্ণ ডোজ সেবন করার অনুরোধ রইল।

সেই সাথে মাউথ ওয়াশ দিয়ে ( ওরোক্লিন ) কুলি করলে বেশ ভাল হবে বা নরমাল স্যালাইন (ওয়াটার গার্গেল) গরম পানি দিয়ে গড়গড়া কুলি করা উচিৎ । জ্বর থাকলে এনালজেসিক ( প্যারাসিটামল ইত্যাদি ) ঔষধ খেতে পারেন । সর্দি কাশি থাকলে এন্টিহিস্টামিন ও কিছুটা সহায়ক তবে ডাইলেটর জাতীয় ঔষধ ( ভেল্টলিন ) সেবন করতে হলে চিকিৎসকের পরামর্ষে নিবেন কিন্তু ভাইরাল সঙ্ক্রামনে হলে এন্টিবায়োটিক সেবন কোন কাজে আসবে বলে মনে হয়না — ইত্যাদি

কখন মনে করবেন আপনার টন্সিলাইটিসের জন্য অপারেশন দরকার ?

সব কিছুর পর অনুরুধ থাকবে ব্যাক্টোরিয়া জনিত হলে দেখবেন এন্টিবায়োটিক ঔষধ সেবন করার পর চলে গেছে – অথবা ভাইরাস জনিত হলে ২/৩ সপ্তাহের ভিতর অসুখ টি সেরে যাওয়ার কথা — তারপর ও যদি না কমে এবং নিচের লক্ষণ সমূহ দেখা দেয় তা হলে অপারেশন করা বেশ উত্তম বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা –এ ছাড়া কার ও বেলায় অসুখ টি কমে যাওয়ার পর ও টনসিল দুটি ছোট হতে কিছু সময় লাগে বিদায় যদি ব্যাথা না থাকে তা হলে ভয় পাওয়ার মত কিছু নেই ।

ক্রনিক টনসিলাইটিসের ক্ষেত্রে সাধারণত পরপর তিন বছরের ভিতরে প্রতি বছর চার বার এবং ৫ দিনের বেশি সমস্যা থাকে ( শিশুদের বেলায় বয়স ১৫-১৬ পার হলে টনসিল সমস্যা আর অনেক সময় থাকেনা ) – টনসিল বড় হয়ে শ্বাসনালি বন্ধ হয়ে যাওয়ার মত অনুভব করলে এবং নিঃশ্বাস নিতে অসুবিধা হলে।- টনসিলে যদি ফোঁড়া হয়, অর্থাৎ ইনফেকশন হলে।— বাতজ্বর ( রিউমেটিক ফিভার ) হওয়ার সম্বাভনা থাকলে – গলার অন্যান্য স্থানে পেরিটনসিলার এবসিস – বারবার টনসিলের ইনফেকশনের কারণে টনসিলের আশেপাশের এলাকা বিশেষ করে ঊর্ধ্বশ্বাস নালি, গলবিল, সাইনাস, মধ্যকর্ণ ইত্যাদিতে ইনফেকশন ক্রমশ বাড়তে থাকলে — আর দেরি করা উচিৎ হবেনা — তখন অনেকেই আর ভিন্ন পদ্ধতির চিকিৎসা করে অসুখ টিকে কোন কোন সময় ভিন্ন মারাত্মক পর্যায়ে নিয়ে যান তখন শেষ মেষ খুভ বড় ধরণের ক্ষতি হবেই অথবা স্থায়ী অবস্থায় গলার যে কোন অঙ্গের বিকলাঙ্গতা জাতীয় সমস্যা দেখা দেওয়া অসম্বভ কিছু নয় ।

কিভাবে সতর্ক থাকবেন টন্সিলাইটিসে যারা ভোগেন

সাধারণভাবে টনসিলাইটিসে আক্রান্ত হবার কয়েক দিনের মধ্যে রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়। তারপরও কিছু সতর্কতা বিশেষতঃ খাদ্যাভাসের কিছুটা পরিবর্তন করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এই অবস্থায় শরীরে পানি শূন্যতা (Dehydration) দেখা দেয়- প্রকটভাবে। সেজন্য প্রচুর পরিমাণে পানি সহ যে কোন পানীয় খাওয়া যেতে পারে। গরম যে কোন পানীয় (অত্যাধিক গরম নয়) যেমন : হালকা গরম চা, চকোলেট পানীয়, কুসুম গরম পানি সাথে মধু, এমন কি ঠান্ডা পানীয় যথা মিল্কসেক (Milk shake) খাওয়া যায়। কোমল পানীয়র মধ্যে আদা পানি (Ginger ale) এসময় উপকারে হয়।

তবে কোন এসিড জাতীয় পানি না খাওয়া ভাল : কোক, স্প্রাইট খাওয়া যাবে না। এসিড জাতীয় পানি গলায়- ইনফেকশনে উত্তেজক হিসাবে কাজ করে। এর পাশাপাশি নরম খাবার যথা জাউ ভাত, যে কোন স্যুপ এসময় অনেক উপকার দেয়।

খাওয়া-দাওয়ার পাশাপাশি- এক কাপ কুসুম গরম পানির সাথে ১/৪ চা চামচ লবন মিশিয়ে গার্গল করলে খুব ভালো ফল পাওয়া যায়। দিনে অন্ততপক্ষে ৩/৪ বার করা উচিত। সাথে প্রচুর বিশ্রাম নিতে হবে।

টনসিলাইটিস হলে বেশি বেশি তরল খাবার ও গরম পানীয় পান করতে হবে। শিশুদের গরম স্যুপ, জাউ বা নরম করে রান্না করা খাবার দিলে ভালো। গলায় ঠান্ডা লাগানো যাবে না।
Tonsillectomy অপারেশনের রোগীর মধ্যে শতকরা ২০ ভাগ রোগী পরোক্ষভাবে সিগারেটের ধোঁয়া হতে আক্রান্ত হয়। তাই ঘরের মধ্যে বাচ্চার সামনে সিগারেট খাওয়া হতে দূরে থাকুন তাহলেই আপনি ও আপনার বাচ্চা দু’জনেই এই রোগের হাত হতে দূরে থাকতে পারবেন।

বিড়াল বা ঐ জাতীয় পোষা প্রাণী ভাইরাস জাতীয় পুরাতন টন্সিলাইটসের বেলায় কিছুটা পরোক্ষ ভাবে প্রভাবিত করে বিধায় শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে যোগাযোগের দূরত্ব বজায় রাখবেন –

Related Articles

Back to top button