স্বাস্থ্য টিপস

আদার আরেক নাম দাদা! দেখে নিন আদা খেলে শরীরে কি হয়?

কাঁচা আদা চিবিয়ে খেলে ব্যায়ামজনিত মাসল পেইন ২৫ শতাংশ কমে যায়। এছাড়াও কাঁচা আদা খেলে মুখের রুচি ফিরে আসে, সাইনাসের সমস্যা প্রতিরোধ হয়, বমি ভাব দূর হয়, হজমে সহায়তা করে, বয়সের ছাপ রোধ করে। তবে চিবিয়েই খান বা অন্যভাবেই খান, আদার রয়েছে কিছু ক্ষতিকারক দিক। যেমনঃ যাদের হেমোফিলিয়া আছে তাদের আদা খাওয়া অনুচিত, পিত্তথলিতে পাথর থাকলে আদা খাওয়া বারণ, খাদ্য নালীতে ঘা থাকলে আদা এড়িয়ে চলতে হবে, গর্ভাবস্থায় আদা ক্ষতিকারক, ডায়াবেটিকগণ আদা খেলে হিতে বিপরীত ফল পেতে পারেন, কোনো অপারেশনের আগে আদা খেলে অধিক রক্তপাত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

আদা শরীরের জন্য খুব উপকারী। এতে রয়েছে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল এজেন্ট, যা শরীরের রোগ-জীবাণুকে ধ্বংস করে। জ্বর জ্বর ভাব, গলা ব্যথা ও মাথাব্যথা দূর করতে সাহায্য করে। তবে রান্না করার চেয়ে কাঁচা আদার পুষ্টিগুণ বেশি। মাইগ্রেনের ব্যথা ও ডায়াবেটিস জনিত কিডনির জটিলতা দূর করে আদা।

আদা কুচি বা আদা বাটা আমরা সাধারণত খাবারের স্বাদ বাড়ানোর কাজেই ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু আপনি জানেন কি, আদা খাবারে স্বাদ বাড়ানোর পাশাপাশি আমাদের দেহের সুস্থতার জন্য বিশেষভাবে উপযোগী?

বাংলাদেশে প্রায় ১৯,০৫৫ একর জমিতে ফলে বছরে প্রায় ৪৯,৪০৫ মে টন আদা। মসলা ও আচারের উপকরণ হিসেবে আদা অধিক ব্যবহূত হয়। আদার ঔষধি গুণও রয়েছে। বৃষ্টিধৌত উঁচু জমি ও পাহাড়ের উতরাইয়ে আদার চাষ ভাল হয়। দিনাজপুর, রংপুর, টাঙ্গাইল ও রাঙ্গামাটি জেলায় আদার অধিক ফলন হয়।

এছাড়াও কাঁচা আদা খাওয়ার রয়েছে দারুণ সব উপকারিতা। চলুন তবে আজকে জেনে নেয়া যাক সাধারণ আদার দারুণ সব উপকারিতা সম্পর্কে।

১) খেতে একেবারেই ইচ্ছে হচ্ছে না? অসুস্থ বোধ করছেন খাবার দেখলেই? কোনো সমস্যাই নয়। খাওয়ার আগে ১ চা চামচ তাজা আদা কুচি খেয়ে নিন। মুখের রুচি ফিরে আসবে।

২) হাতে পায়ের জয়েন্টে ব্যথা হলে সাহায্য নিতে পারেন আদার তেলের। খানিকটা অলিভ অয়েলে আদা ছেঁচে নিয়ে ফুটিয়ে নিন ৫ মিনিট। ঠাণ্ডা হলে ছেঁকে এই তেল দিয়ে ম্যাসাজ করুন হাতে পায়ের জয়েন্টে। আদার অ্যান্টিইনফ্লেমেটরি উপাদান দূর করে দেবে ব্যথা।

৩) প্রতিদিন মাত্র ১ ইঞ্চি পরিমানের আদা কুচি খাওয়া অভ্যাস সাইনাসের সমস্যা প্রতিরোধে সহায়তা করে।

৪) বমি বমি ভাব হচ্ছে? কিংবা মাথা ঘুরানো? একটুখানি আদা স্লাইস করে লবণ দিয়ে চিবিয়ে খেয়ে নিন। দেখবেন বমি ভাব একেবারেই কেটে গিয়েছে।

৫) জ্বর, ঠাণ্ডা লাগা, ব্যথায় আদা উপকারী। কারণ আদায় এমন কিছু উপাদান রয়েছে, যা বডি টেম্পারেচারে ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। শীতকালে ঠাণ্ডার সময় তাই আদা চা খেতে পারেন।

৬) ঋতু পরিবর্তনের সময় অ্যাজমা, মাইগ্রেনের মতো সমস্যা প্রায়শই দেখা যায়। এই সময়ে ডায়েটে আদা রাখুন। সর্দি-কাশির প্রকোপের সময় মুখে আদা রাখলে, আরাম পাবেন।

৭) গা গোলানো ও বমিভাব থেকে রেহাই পেতে কয়েক কুচি আদা চিবিয়ে খেয়ে দেখুন। সমস্যা অনেকটা কমবে।

৮) আর্টারি ওয়ালে ব্যাড কোলেস্টেরল (Bad Cholesterol) ও ফ্যাটি অ্যাসিড জমে করোনারি হার্ট ডিজিজের সমস্যা দেখা যায়। ফলে রক্ত চলাচলে অসুবিধে দেখা যায়। আদা রক্ত চলাচলে সাহায্য করে। লিভার ও ব্লাডে কোলেস্টেরল অ্যাবজর্বশন কম রাখতে আদা সাহায্য করে।

৯) অতিরিক্ত ওজন ঝরাতেও আদা সাহায্য করে। টিস্যু বেশি এনার্জি ব্যবহার করায়, বেশি ক্যালরি বার্ন হয়।

১০) অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর আদা ক্যান্সার ও হার্টের সমস্যা প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। বিশেষ করে ওভারিয়ান ক্যান্সার প্রতিরোধে আদা উপকারী।

১১) হজমে সমস্যার কারণে পেতে ব্যথা হলে আদা কুচি খেয়ে নিন। আদা পেতে গ্যাসের সমস্যা থেকেও মুক্তি দিতে বেশ কার্যকরী।

১২) খাবারের পুষ্টি দেহে সঠিকভাবে শোষণ করার ক্ষমতা বাড়ায় আদা। তাই প্রতিদিন খুব সামান্য পরিমাণে হলেও আদা খাওয়া অভ্যাস করা উচিত সকলের।

১৩) বুকে সর্দি কফ জমে গিয়েছে? নিঃশ্বাস টানতে সমস্যা হচ্ছে? ২ কাপ পানিতে আদা কুচি দিয়ে ফুটিয়ে নিন। পানি যখন অর্ধেক হয়ে আসবে জ্বাল হয়ে তখন ছেঁকে নামিয়ে ১ টেবিল চামচ মধু মিশিয়ে পান করে ফেলুন। বেশ আরাম পাবেন। সর্দি কফের সমস্যা না যাওয়া পর্যন্ত এই আদা চা পান করে চলুন।

১৪) ত্বকে পড়ে যাচ্ছে বয়সের ছাপ? এক কাজ করুন প্রতিদিন সামান্য আদা কাচা চিবিয়ে খাওয়ার অভ্যাস করুন। আদার মধ্যে রয়েছে অ্যান্টিএইজিং উপাদান ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা দেহের টক্সিন দূর করে এবং দেহে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে ত্বকে বয়সের ছাপ প্রতিরোধ করে অনেকটা সময়।

আদা মসলা হিসেবে ব্যবহূত Zingiberaceae গোত্রের সুগন্ধি ঔষধি Zingier officinale। এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থানীয় এক প্রজাতি। রাইজোম (rhizome) বাইরের দিকে হলুদাভ, ভেতরে হালকা সবুজ-হলুদ। বড় বড় বিন্যস্ত পাতার অনেকগুলি চওড়া বৃন্তে গঠিত ভুয়োকান্ড উপরে ১৫ সেমি পর্যন্ত লম্বা।

১০০ গ্রাম আদায় রয়েছে –

এনার্জি: ৮০ ক্যালরি
কার্বোহাইড্রেট: ১৭ গ্রাম
ফ্যাট: ০.৭৫ গ্রাম
পটাশিয়াম: ৪১৫ মিলিগ্রাম
ফসফরাস: ৩৪ মিলিগ্রাম

আদার আরো কিছু ওষুধি দিক –
১. আর্থ্রাইটিসের সমস্যায় ভুগলে সারা দিনের খাবারে অল্প পরিমাণে আদা রাখার চেষ্টা করুন। আদা দিয়ে চা খেতে পারেন, সালাদে আদার সরু, লম্বা কুচি মেশাতে পারেন। ব্যথার সমস্যা ধীরে ধীরে কমবে। ঘন ঘন ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়ার অভ্যাস কমিয়ে আদা খেয়ে দেখতে পারেন। আর্থ্রাইটিসের ব্যথা কমাতে জিঞ্জার অয়েল উপকারী।
২. গর্ভবতী মহিলাদের সকালে খারাপ লাগার সমস্যা কমাতে আদা সাহায্য করে।
৩. আদা হজমে সাহায্য করে।

আদার আরেক নাম দাদা! দেখে নিন আদা খেলে শরীরে কি হয়?

১) পরিমিত আদা খাওয়ার অভ্যাসে রক্ত-সঞ্চালন স্বাভাবিক হয়। আদায় রয়েছে ক্রোমিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও জিঙ্ক। এ উপাদানসমূহ রক্ত প্রবাহের প্রক্রিয়াকে স্বাভাবিক রাখে।

২) যানবাহনে চড়ার সময় কেউ কেউ অস্বস্তিতে ভোগেন বা কিছুক্ষণ গাড়িতে থাকার পর বমির প্রবণতা চলে আসে। আদা এক্ষেত্রে বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

৩) খাবার খাওয়ার পর পুষ্টি-উপাদানসমূহ যদি শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও কোষগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণে না পৌঁছায়, সেক্ষেত্রে নানা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। পুষ্টি উপাদানগুলো শোষণ করার ক্ষেত্রে আদা কোষসমূহকে সহায়তা করে।

৪) ঠাণ্ডা লাগা ও ভাইরাস জ্বর প্রতিরোধে আদা বিশেষ ভূমিকা রাখে। এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে হাজার হাজার বছর ধরে প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন রোগ-প্রতিরোধ বা নিরাময়ের ক্ষেত্রে আদার ব্যবহার চলে আসছে।

৫) পেটের অস্বস্তি বা পীড়ায় আদা একটি আদর্শ পথ্য। হজমে সহায়তার পাশাপাশি খাবারের গুণাগুণ শরীরের বিভিন্ন অংশে পৌঁছে দিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখে আদা। কিছু খাওয়ার পর পেটব্যথায় ভোগার সমস্যা থাকলে, সেটা দূর হয়ে যাবে। পেটে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণও প্রতিরোধ করে এটি।

৬) আদা কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে।

৭) ব্যথা ও শরীরে যে কোন ধরনের প্রদাহ কমাতে কাজ করে আদা। প্রাকৃতিকভাবেই এতে রয়েছে ব্যথানাশক উপাদান।

৮) ফুসফুসের সাধারণ যে কোন সংক্রমণ বা রোগের ক্ষেত্রে আদা বেশ কার্যকরী। সর্দি-কাশি, শ্বাস-প্রশ্বাসের সাধারণ সমস্যা দূর করে আদা। গলা ও স্বরতন্ত্রী পরিস্কার রাখে।

৯) ওভারিয়ান ক্যান্সারের চিকিৎসায় আদা অন্যতম ভূমিকা রাখে।

১০) প্রতিদিন নিয়মিত সামান্য আদা খাওয়ার অভ্যাস আপনার শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। বিভিন্ন রোগে অক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বহুলাংশে কমে আসে।

১১) স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায় আদা।

১২) সকালে কেউ কেউ অসুস্থ বোধ করেন। নিয়মিত আদা খান।

সতর্কতা –
১. গলস্টোনের সমস্যা থাকলে কত পরিমাণ আদা খাবেন, ডাক্তারের থেকে জেনে নিন।
২.গর্ভাবস্থায় সারা দিনে ২৫০ গ্রামের বেশি আদা খাবেন না। ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া বাঞ্ছনীয়।

কিভাবে আদা খাবেন –
১. আদায় সামান্য পানি দিয়ে থেতলে নিন। আদার রস ও আদা গরম পানিতে কিছুক্ষণ ফুটিয়ে নিন। চা বানানোর জন্যে এই পানি ব্যবহার করুন।
২. আদা ছিলে , সামান্য লেবুর রস মেশান। হজমে এই মিশ্রণ খুব ভালো কাজ করে।
৩. সারা দিনে ৫০ গ্রাম আদা খেতে পারেন। পাউডারড জিঞ্জার আধা  চামচ করে দিনে ৩ বার খেতে পারেন। আদা সরু লম্বা করে চিকন করে কেটে নিন। সামান্য লবণ, গোলমরিচ মেশান।
৪. পানি ফুটিয়ে নিন। এবারে দুধ, মসলা, আদার রস, চা পাতা দিয়ে আরো একবার ফুটিয়ে নিন। কাপে চিনি দিয়ে পরিবেশন করুন। ওপরে সামান্য এলাচগুঁড়ো ছড়িয়ে দিতে পারেন।
৫. হজমে সাহায্য করার জন্যে আদা দিয়ে সিরাপ বানিয়ে নিন। জিরে গুঁড়ো, বিট নুন, আদার রস, লেবুর রস, ঠাণ্ডা জল একসাথে মিশিয়ে ব্লেন্ড করুন। তৈরি আদার সিরাপ। দুপুরে বা রাতের খাবারের পরে এই সিরাট খেতে পারেন।
৬. ভিনিগারে আদার টুকরো, লবণ, মরিচ দিয়ে কিছু দিন রাখুন। খাওয়ার সময় আচার হিসেবে খেতে পারেন।

যাদের কখনোই আদা খাওয়া উচিৎ নয়

শরীরের নানা রোগ উপশমে আদার উপকারিতা অপরিসীম। রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়ানো ছাড়াও, আর্থারাইটিস, মাইগ্রেন, কাশি, ডায়েরিয়া, গ্যাস, কনস্টিপেশন, হার্টের সমস্যা, ডায়বেটিস, হাই-কোলেস্টেরলের মতো বিবিধ রোগপ্রতিরোধে আদার জুড়ি নেই।

এমনকী ক্যান্সারের কোষবৃদ্ধিতেও বাধ সাধে মাটির নীচের এই ফসল। রোগ প্রতিরোধে আদার উপকারিতার কথা মাথায় রেখে, বিভিন্নওষুধ তৈরিতেও আদা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

কারা আদা এড়িয়ে চলবেন?

১. অন্তঃসত্ত্বারা: 
আদা শরীরে কড়া উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। সেজন্য অন্তঃসত্ত্বারা আদা খেলে, প্রিম্যাচিওর শিশু জন্মের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এজন্য গর্ভবতী মহিলাদের অবশ্যই আদা এড়িয়ে চলা উচিত। বিশেষত প্রেগন্যান্সির শেষ সপ্তাহগুলিতে তো আদা কখনোই খাওয়া উচিৎ নয়।

২. যারা ওজন বাড়াতে চান: 
যারা রোগা হতে চান তাদের জন্য আদা বিশেষ উপকারী হলেও, যারা শীর্ণকায়, ওজন বাড়াতে উত্‍‌সাহী তাদের অবশ্যই আদা এড়িয়ে চলা উচিত। কারণ আদা খিদে কমায়। এছাড়াও শরীরের চর্বি গলানোর প্রক্রিয়ায় আদা বিশেষ সহায়ক। সেজন্য যারা ওজন বাড়াতে চান, আদা তাদের কোনওকাজে আসবে না।

৩. ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে যারা ওষুধ খান: 
আদা ডায়াবেটিসেরলেভেল কমাতে কার্যকরী হলেও, যারা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মিত ওষুধ খান, তাদের ডায়েট চার্ট থেকে চিরতরে ডিলিট করে দিতে হবে আদাকে। একই কথা প্রযোজ্য উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্যও। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে যারা নিয়মিত ওষুধ খান, তাদেরও অবশ্যই আদাকে এড়িয়ে চলা উচিত।

Related Articles

Back to top button