মেহেরপুরে দুই উপজেলার মানুষের একমাত্র ভরসা বাঁশের সাঁকো, অর্ধশত বছরেও মেলেনি ব্রিজ!
মেহেরপুর সদর ও গাংনী উপজেলার ১৫টি গ্রামের মানুষের চলাচলের একমাত্র ভরসা নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো। একটি ব্রিজের জন্য চাতক পাখির মতো চেয়ে আছে ৫১ বছর ধরে। তাপরও মেলেনি ব্রিজ নামের সেই সোনার হরিণ।
সরকার আসে, আবার পরিবর্তনও হয়। ভোটের সময় রাজনীতিবিদরা আসেন। জনগণের দুঃখ দুর্দশার কথা শুনে চোখের পানিও ফেলেন। আবার নির্বাচিত হলে সবই ভুলে যান। এভাবেই চলছে, আশা-নিরাশারা দোলাচলে ৫১ বছর।
জনপ্রতিনিধিদের প্রতিশ্রুতি আর জনগণের প্রত্যাশার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে দুই উপজেলার গাঁড়াবাড়ীয়া-হিতিমপাড়া গ্রামের ভৈরব নদীর উপর খেয়াঘাটের ব্রিজ নির্মাণ। এলাকার মানুষের প্রত্যাশিত ব্রীজটি নির্মান না হওয়ায়, বাঁশের সাঁকোই শেষ সম্বল।
জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন চলাচল করে, দু-উপজেলার ১৫ গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ। নিজেদের প্রয়োজনের তাগিদে, বিগত ৫১ বছর যাবৎ গ্রামের মানুষ বাঁশ-খুটি দিয়ে, সেতু তৈরী করে, চলাচলের ব্যবস্থা করেছে। এই নড়বড়ে বাঁশের সাঁকোই অনেকবার ঘটেছে দুর্ঘটনা। অনেকেই হয়েছে আহত। তারপরেও গ্রামের মানুষের চলাচলে একমাত্র ভরসা এই নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, চলাচল করলেও আজও চোখে পড়েনি জনপ্রতিনিধি বা সরকারী কোন কর্তৃপক্ষের। ফলে দুটি উপজেলার (সদর ও গাংনী) মানুষের সেতু বন্ধন অধরাই রয়ে গেছে। বাঁশের সেতুটি দিয়ে, সদর উপজেলার হিতিমপাড়া, কুতুবপুর, তেরঘরীয়া, শোলমারী, ভিটাপাড়া, রামদাসপুর শুভরাজপুর, কালিগাংনী, দিঘিরপাড়া, উজলপুর এবং গাংনী উপজেলার গাড়াবাড়ীয়া, কাথুলী, সহগলপুর, রামকৃষ্ণপুর ধলা, রাধাগোবিন্দপুর ধলাসহ ১৫ টি গ্রামের মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হয়ে থাকেন এই বাঁশের সাঁকো দিয়ে।
সাঁকোটির পশ্চিম পাশের অন্তত ৫ টি গ্রামের মানুষকে নিত্যদিন তাদের কৃষি পণ্য সংগ্রহ, বিপণন, চিকিৎসা ও শিক্ষার্থীদের স্কুল কলেজে যেতে হয়। গাড়াবাড়িয়া গ্রামে পূর্ব দিকেরও ৫টি গ্রামের মানুষকে নানা কাজে যাতায়াত করতে হয় নদীর অপর দিকের গ্রামগুলোতে। গত বছর ভারি বর্ষণে বাঁশের সাঁকোটি পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় দুর্বল হয়ে গেছে। এখন দুর্বল কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে আছে সাঁকোটি। ভেঙ্গে গিয়ে যে কোন সময় মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এমন আশঙ্কা এলাকাবাসীর।
মেহেরপুর শহর থেকে উত্তরাঞ্চলের ব্রিজ গুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম ব্রিজ হবে, গাড়াবাড়িয়া-হিতিমপাড়া সেতু। ভৈরব নদী খননের পর ওই সাঁকোর আশে-পাশে কম গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় চারটি ব্রিজ নির্মাণ করা হলেও গাড়াবাড়িয়া-হিতিমপাড়া ব্রিজটি আজও নির্মাণ করা হয়নি।
গাড়াবাড়ীয়া গ্রামের আব্দুর রশিদ জানান, ছোট বেলা থেকেই শুনে আসছি ব্রিজটি হবে। কিন্তু অদ্যাবধি ব্রিজ নির্মাণ হয়নি। হয়তো আমরা ব্রিজ দেখে যেতে পারবো না। প্রতি বারই জনপ্রতিনিধিরা আমাদের বিভিন্ন আশ্বাস দিয়ে যান কিন্তু তার বাস্তবায়ন হয়না।
আমেনা খাতুন নামের এক বৃদ্ধা জানালেন, ভোটের সময় ভোট নিতে আসে। সে সময় আমাদের বিভিন্ন আশ্বাস দেই তারা। বলে আমি নির্বাচিত হলে, ব্রিজ নির্মাণ করে দেবো। কিন্তু ভোট পেয়ে ভুলে যায় তার দেওয়া প্রতিশ্রুতি।
হিতিমপাড়া এলাকার কৃষক বাদল আলী জানান, এই ভয়ঙ্কর সাঁকো দিয়েই এলাকার কৃষকরা, তাদের উৎপাদিত পণ্য মাঠ থেকে বাড়ি নিয়ে আসেন। অনেকবার ভেঙ্গে পড়ে গেছে। কৃষকরা হারিয়েছেন ফসল।
গাঁড়াবাড়িয়া গ্রামের রহিম উদ্দীন ও এলেম উদ্দীন বলেন, এলাকার সংসদ সদস্য, এলজিইডি থেকে বার বার আশা-ভরসা দিলেও ব্রিজটি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি কেউ।
স্থানীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাবিয়া খাতুন, লাভলী খাতুন, রাসেল আহমেদ বলেন, ব্রিজ না থাকায় বাঁশের সাঁকো দিয়ে, জীবনের ঝুকি নিয়ে, স্কুলে যাতায়াত করতে হয়। বর্ষার সময় সাঁকো ডুবে গেলে, অনেক দুরের রাস্তা কাথুলী ব্রিজ দিয়ে স্কুল ও কলেজে যেতে হয়। তাতে খরচ বেশি হওয়া সহ পড়াশুনা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়।
কুতুবপুর স্কুল এন্ড কলেজের আক্তারুজ্জামান লাভলু বলেন, উপজেলার দু’টি ইউনিয়নের ১৫ গ্রামের ছেলে-মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার জন্য এই সাঁকো দিয়ে, যাতায়াত করতে হয়। অথচ কম গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ব্রিজ হলেও এই ব্রিজটি আজও হলো না।
কাথুলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান রানা বলেন, শত বছরের পুরাতন এই খেয়া ঘাটটিতে আজও ব্রিজ নির্মাণ করা হয়নি। ব্রিজ নির্মাণ হলে, দুই উপজেলার মানুষ সুফল ভোগ করবে। ব্রিজটি দ্রুত নির্মাণের দাবি করে তিনি বলেন, এতদঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের প্রাণের দাবি ব্রিজ নির্মাণের। ব্রিজটি নির্মিত হলে শিক্ষার পাশাপাশি অর্থনেতিক উন্নয়ন হবে। পাশাপাশি জনগণের দুর্ভোগ কমবে।
গাংনী এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলী ফয়সাল হাসান বলেন, গাড়াবাড়িয়া-হিতিমপাড়া ব্রিজ নির্মাণে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। তবে ত্রুটিযুক্ত হওয়ায় তা ফিরে এসেছে। আমরা আবার সংশোধন করে প্রস্তাবটি পাঠিয়ে দেব।